আত্মসমর্পণের পর লতিফ কারাগারে

আত্মসমর্পণের পর সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে ধর্মীয় উসকানির এক মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Nov 2014, 07:50 AM
Updated : 6 Dec 2014, 10:49 AM

ঢাকার মহানগর হাকিম আতিকুর রহমান মঙ্গলবার দুপুরে এই আদেশ দেন। এর পরপরই তাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।   

যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে মন্তব্যের কারণে মন্ত্রিত্ব ও আওয়ামী লীগের সদস্যপদ হারানো এই সংসদ সদস্যের পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।  তার পক্ষে কোনো জামিন আবেদনও করা হয়নি।

আইনজীবীর বদলে লতিফ নিজেই আদালতে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পাননি। 

আদালতের আদেশের ঘণ্টাখানেক আগে রাজধানীর ধানমণ্ডি থানায় ধরা দেন লতিফ। ডজনখানেক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে গত রোববার রাতে দেশে ফেরার পর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।

আগাম জামিন চাইতে লতিফ হাই কোর্টে যাচ্ছেন বলে খবর চাউর হলে সোমবার দিনভর গুঞ্জন চলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানে তাকে দেখা যায়নি। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার না করায় রাজপথ থেকে সংসদ- সব স্থানেই চলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, হরতালের ঘোষণাও আসে।   

ধানমণ্ডি থানার এসআই ইফতেখারুল আলম জানান, মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে থানায় এসে লতিফ সিদ্দিকী জানতে চান ওসির কক্ষ কোন দিকে। তাকে থানায় দেখে পুলিশ সদস্যরা বিস্মিত হন।

ওসির কক্ষ দেখিয়ে দেওয়ার পর ভেতরে যান লতিফ। সেখানে কিছু সময় কথা বলার পর ওসি আবু বকর সিদ্দিকী তাকে নিয়ে রওনা হন আদালতের দিকে।

ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নেওয়ার পর লতিফ সিদ্দিকীকে কিছু সময় হাজতখানায় রাখা হয়। পরে আইনজীবী এ এন এম আবেদ রাজার দায়ের করা মামলার গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আদালতে তোলা হয়।

বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী ফোরামের নেতা আবেদ রাজা গত ২ অক্টোবর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলা করেছিলেন।  তার অভিযোগ ছিল, হজ নিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে। 

গত ২৮ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল সমিতির ওই অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, তিনি হজ ও তাবলিগ জামাতের ঘোর বিরোধী। এতে শ্রমশক্তি ও অর্থের অপচয় হয়।

বিচারক ওইদিন লতিফ সিদ্দিকীকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলেও তিনি হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

একই অভিযোগে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ও ২৯৮ ধারায় ডজনখানেক মামলায় লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়,যার মধ্যে সাতটি মামলা ঢাকার আদালতের। দুটি ধারাই জামিনযোগ্য।

দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারায় অন্যের ধর্ম বিশ্বাসের অবমাননা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে বিদ্বেষমূলক কোনো কাজ করলে দুই বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে।

আর দণ্ডবিধির ২৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে বিদ্বেষমূলক শব্দ উচ্চারণ করলে এক বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা হতে পারে।

মঙ্গলবার আদালতে হাজির করার পর মহানগর হাকিম আতিকুর রহমান জানতে চান লতিফ সিদ্দিকী কোনো আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন কি-না, অথবা কোনো ওকালতনামা জমা দিয়েছেন কি-না।

জবাবে এই সাংসদ বলেন, নিজের বক্তব্য তিনি নিজেই আদালতকে বলতে চান।

এ সময় বিচারকের অনুমতি নিয়ে বাদী আবেদ রাজা বলেন, “আমি লতিফ সাহেবের পরিবারের প্রায় সবাইকেই চিনি। পারিবারিকভাবে তিনিসহ তার পরিবারের অপর সদস্যরাও আমাকে চেনেন। তার বিরুদ্ধে আমার মামলা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তার ওইরকম বক্তব্যে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। বাধ্য হয়ে যন্ত্রণার কারণে আমি এ মামলা করেছি।”

পাঁচ মিনিটের মাথায় লতিফ সিদ্দিকীকে কোনো বক্তব্য রাখার সুযোগ না দিয়ে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন।

আদেশে বিচারক বলেন, “যেহেতু আসামি কোনো জামিন চাননি , তার পক্ষে কোনো জামিনের আবেদনও নেই। সে কারণে তাকে জেল হাজতে পাঠানো হোক।”

সাদা জুতা, কালো প্যান্ট ও সাদা চেক শার্ট পরিহিত এই রাজনীতিবিদকে আদালতে তার স্বভাবসুলভ মেজাজেই দেখা যায়। তেমন কোনো উদ্বেগ বা শঙ্কার ছাপ তার চেহারায় দেখা যায়নি।

লতিফকে প্রিজনভ্যানে তোলার সময় কয়েকশ আইনজীবী ঝাড়ু ও জুতা হাতে মিছিল করেন। লতিফকে ‘নাস্তিক’ ও ‘মুরতাদ’ আখ্যায়িত করে তার ফাঁসির দাবি করেন তারা।

বেলা ৩টা ২৫ মিনিটে প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে কারাগারের মূল ফটকের সামনে এসে বেঁকে বসেন লতিফ। মাথা নিচু করে ‘পকেট ফটক’ দিয়ে ঢুকতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের তিনি বলেন “আমি এখনো এমপি। গত ৩০ বছর আমি পকেট গেইট দিয়ে ইন বা আউট হইনি।”

সংবাদকর্মীরা আদালতের আদেশের বিষয়ে মন্তব্য চাইলে মাথা নেড়ে লতিফ বুঝিয়ে দেন, তিনি কিছুই বলবেন না।   

১৭ মিনিট পর কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার ফরমান আলী বাইরে আসেন এবং প্রধান ফটক খুলে দেওয়া হয়। এরপর ফরমান আলীর সঙ্গেই ভেতরে প্রবেশ করেন গত দুই মাস ধরে আলোচনায় থাকা লতিফ সিদ্দিকী।

টাঙ্গাইলে প্রভাবশালী সিদ্দিকীদের জ্যেষ্ঠ ভাই ৭৭ বছর বয়সী লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতি) আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য হয়েছেন।

গত মহাজোট সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর চলতি বছরের শুরুতে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে।

কিন্তু নিউ ইয়র্কে তার ওই মন্তব্যের পর আলোচনা-সমালোচনার এক পর্যায়ে ইসলামী দলগুলো আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেয়। নিজের দলেও লতিফ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।

এরপর টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে বাদ দেওয়া হয়। দল থেকেও বহিষ্কৃত হন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য।

ডামাডোলের এই পুরোটা সময় বিদেশেই ছিলেন ৭৭ বছর বয়সী লতিফ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি যান ভারতে, সেখান থেকে আকস্মিকভাবে রোববার রাতে দেশে ফেরেন।