বিটিভির চার কর্মকর্তা হত্যার বিচার হয়নি ৩৯ বছরেও

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের চার কর্মকর্তাকে হত্যার বিচার হয়নি ৩৯ বছরেও।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসও শিকদার খালিদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Nov 2014, 04:59 AM
Updated : 7 Nov 2014, 07:02 AM

দশ বছর ধরে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে মামলার বিচার কাজ। নিহত চার কর্মকর্তার স্মরণে বর্তমান সরকারের সময়ে বিটিভি ভবনে চারটি স্টুডিওর নামকরণ হলেও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্রপক্ষে দেখা যায়নি। 

রামপুরা টেলিভিশন ভবনে নিহত ওই চার কর্মকর্তা হলেন- টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্রের অন্যতম স্থপতি, পাক্ষিক বিচিত্রার সম্পাদক, বিটিভির তৎকালীন উপমহাপরিচালক মনিরুল আলম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ বি সিদ্দিক, প্রধান হিসাবরক্ষক আকমল খান ও চিত্রগ্রাহক ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী।

হত্যাকাণ্ডের পরের বছর হাতিরঝিল থেকে তিনজনের কংকাল পাওয়া গেলেও মনিরুলের লাশ বা তার কোন চিহ্ন পায়নি পরিবার। কংকালগুলো আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা  হয়।

ওই ঘটনায় চার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে অপহরণ মামলা দায়ের করা হলেও পরে তা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য শুরুর পর ২০০৪ সালের ২৬ মে হাই কোর্ট মামলার বিচার স্থগিতের আদেশ দেয়। 

অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় বা বিচারিক আদালতের সংশ্লিষ্ট কেউ এ মামলার বর্তমান অবস্থা জানাতে পারেননি। এর ভবিষ্যত নিয়েও কোনো আভাস দিতে পারেননি।

এ মামলার এক নম্বর সাক্ষী ও নিহত মনিরুলের শ্যালক মোহাম্মাদ আলী স্বপন বলেন, “হাই কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে হত্যাকারীরা বহাল তবিয়তে আছে। মামলা চলাকালে আসামিদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও পরে তারা পেনশনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। এমনকি কারও কারও পদোন্নতিও হয়েছিল।”

নিহত চারজনের মধ্যে তিন জনের স্ত্রী মারা গেছেন। মনিরুল আলম ছাড়া বাকিদের সন্তানরা  দেশের বাইরে থাকেন। মনিরুলের ছেলে রাশেদ আলম একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কাজ করেন।

মামলার নথিপত্র থেকে  জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রেডিও ও টিভি স্টেশনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ওই সময় দাবিদাওয়া নিয়ে বিটিভির তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কল্যাণ সমিতির আন্দোলন চলছিল। কিন্তু বিটিভির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের দাবি মানতে রাজি ছিল না।

ওই অবস্থায় রামপুরা টিভি ভবনে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর অনারারি লেফটেন্যান্ট (অব.) আলতাফ হোসেনের সঙ্গে কর্মচারী নেতাদের সমঝোতা হয়। তাদের দাবি আদায় করা হবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়।

১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাতে আলতাফসহ আসামিদের বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আটক করে দাবি আদায় করা হবে। পরদিন সকালে আলতাফের নেতৃত্বে মামলার অপর আসামিরা বিটিভির ফটকে দাঁড়িয়ে থাকেন, কর্মকর্তাদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় সাদা কাগজে সই নিয়ে।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মনিরুল, আকমল ও সিদ্দিক ফটকে প্রবেশ করলে আলতাফ, বিটিভির সাবেক সহকারী পরিচালক আবুল কাশেম বাগোজা ও আব্দুল আওয়াল সরকার, প্রযোজক লুৎফর রহমান, অধিবেশন নিয়ন্ত্রক সৈয়দ আইনুল কবির, ডিউটি অফিসার আইনুজ্জামান ও মো. সাহজাহান মিয়াজী তাদের আটক করে। এই সাতজনই এ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। 

অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিটিভির তখনকার মহাপরিচালক জামিল চৌধুরী ও জেনারেল ম্যানেজার মুস্তাফা মনোয়ারকেও সেদিন আটক করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেদিন অফিসে না আসায় তারা প্রাণে বেঁচে যান।

আটক তিন কর্মকর্তাকে বিটিভির ১০১ নম্বর কক্ষে আটকে রাখার পর দুপুরের দিকে টিভি ভবনে আসেন ক্যামেরাম্যান ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী। তিনি কর্মকর্তাদের আটকে রাখার প্রতিবাদ করলে তাকেও আটকে ফেলা হয়।

৭ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে বিটিভির সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। তিন কর্মকর্তাকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় টিভি ভবনের পিছনে ঝিলপাড়ে।

সেখানে আলতাফের নেতৃত্বে সাত আসামি তাদের গুলি করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে হাতিরঝিলের পানিতে লাশ ফেলে দেয় বলে মামলার নথিপত্রে বলা হয়।

চার দিন পর লাশ ভেসে উঠলে আসামিরা টেলিফোন ও টিভি এন্টেনার তারের সঙ্গে ইট বেঁধে সেগুলো আবার ডুবিয়ে দেয় বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

চার কর্মকর্তার খোঁজ না পেয়ে ১৯৭৫ সালের ১৯ নভেম্বর তাদের স্ত্রীরা গুলশান থানায় চারটি অপহরণ মামলা করেন। হাতিরঝিলের পানি শুকিয়ে গেলে ১৯৭৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনটি কংকাল পাওয়া যায়। সেগুলো ঠেলাগাড়িতে করে গুলশান থানায় নিয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে।

পরীক্ষার পর কংকালগুলো কাইয়ুম, সিদ্দিক ও আকমলের বলে চিহ্নিত করা হলেও মনিরুলের কোনো চিহ্ন মেলেনি।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক  জাহাঙ্গীর হোসেন ‘নামমাত্র তদন্ত করে’ ১৯৭৮ সালের ৯ জানুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ফলে আটকে যায় হত্যাকাণ্ডের বিচার।

১৮ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আকমলের স্ত্রী মনোয়ারা আকমল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার খালেক উজ জামান। ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ আদালত আবেদনটি গ্রহণ করলে মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হয়।

দীর্ঘ তদন্তের পর মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা মো. ফজলুল করিম খান ১৯৯৯ সালের ১৮ অগাস্ট অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারও করে। পরে তারা জামিনে মুক্ত হন।

২০০২ সালের ৭ অগাস্ট মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসে। পরের বছর ১৬ অগাস্ট নয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- একএম জাকারিয়া হায়দার, আবুল কাশেম, সৈয়দ আইনুল কবীর এবং আয়নুজ্জামান এবং মো. সাহজাহান মিয়াজী, আবুল কাশেম বাগোজা, লুৎফর রহমান তালুকদার, আলতাফ হোসেন ও আবদুল আউয়াল সরকার।

আসামিদের আবেদনে ২০০৪ সালের ২৬ মে হাই কোর্ট এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়। দফায় দফায় এর মেয়াদ বাড়তে থাকে এবং সর্বশেষ গতবছর ৩১ জানুয়ারি রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দেয় হাই কোর্ট।

আসামিদের মধ্যে আয়নুজ্জামান ২০০৪ সালের ৪ জুন মারা যান। ২০০৫ সালের ১৭ এপ্রিল হাই কোর্ট আবুল কাশেম বাগোজা, আবদুল  আউয়াল সরকার ও লুৎফর রহমান তালুকদারকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়।

ওই বছর ১৯ মে মনিরুলের শ্যালক মহম্মদ আলী স্বপন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষ তাকে জেরাও  শুরু করে। কিন্তু পরে স্থগিতাদেশে বিচার আটকে যায়।

স্বপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মনিরুলকে আটকে রাখার খবর পেয়ে তার স্ত্রী আনোয়ারা আলমকে নিয়ে টিভি ভবনে ছুটে যান তিনি। সেখানে আলতাফ হোসেনের সঙ্গেও তাদের কথা হয়।

আলতাফ তাদেরও গ্রেপ্তারের হুমকি দিলে বাধ্য হয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে যান বলে স্বপন জানান।

বোনকে বাড়ি পৌঁছে স্বপন আবার রামপুরা টিভি ভবনের সামনে আসেন। খুন করে লাশ ঝিলে ফেলে দেওয়ার কথা শুনে পরদিন আলতাফের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন, মনিরুল ভালো আছেন, বিকেলের মধ্যেই বাসায় ফিরে যাবেন।

এ মামলার কার্যক্রম শুরু করতে আইনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে সাক্ষী মোহাম্মাদ আলী স্বপন বলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস একটু নড়াচড়া করলে হয়তো ১০ বছর পড়ে থাকা মামলাটির গতি হতে পারে।”

এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে  অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চাইলে তিনি সরাসরি তার কার্যালয়ে এসে কথা বলতে পরামর্শ দেন।

একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে এ মামলার রুল শুনানির অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনিও কিছু  বলতে পারেননি।

এ বিষয়ে জানতে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি হাই কোর্টে দায়ের করা মামলা খারিজের আবেদনের নম্বর চান।

তিনি বলেন, “নম্বর পেলে আমি অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে পারব।”