এবার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির অপেক্ষা

আপিলেও মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকায় একাত্তরের বদর নেতা কামারুজ্জামানের সাজা কার্যকর করার জন্য এবার শুরু হলো রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির অপেক্ষা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2014, 07:43 AM
Updated : 3 Nov 2014, 10:50 AM

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু রায়ের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর তা ট্রাইব্যুনালে গেলে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে। এরপর সরকার তা কার্যকর করবে।”

এর আগে কাদের মোল্লার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের তখনকার সমন্বয়ক এম কে রহমান বলেছিলেন, আইন অনুসারে সরকারের সিদ্ধান্তে এই রায় বাস্তবায়ন হবে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার চাইলে কারাবিধিও (জেল কোড) অনুসরণ করতে পারে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে আপিলের রায়ের প্রায় আড়াই মাস পর পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়েছিল। আপিলের রায় ঘোষণার পর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সাজা কার্যকর করতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন মাস।

কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তখনকার আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “দ্রুততম সময়ের মধ্যেই রায় কার্যকর হবে, ওয়েট অ্যান্ড সি। রায় কার্যকরে এখন আর কোনো বাধা নেই।”

তিনি সে সময় বলেন, এই রায় নিয়ে ‘রিভিউ পিটিশন’ করার কোনো সুযোগ নেই। রায় কার্যকরের সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমাও নেই।

অবশ্য কাদের মোল্লার আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক সে সময় দাবি করেন, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে এই জামায়াত নেতারও ‘রিভিউ পিটিশন’ করার অধিকার আছে। রায়ের সত্যায়িত কপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তারা এই ‘পিটিশন’ করবেন।

সাধারণ মামলা সম্পর্কে কারাবিধিতে বলা হয়েছে, স্পেশাল লিভ পিটিশন (চূড়ান্ত আপিল) খারিজের সংবাদ পাবার সঙ্গে সঙ্গে সরকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেল সুপারকে টেলিগ্রামের মাধ্যমে তা জানাবেন। এরপর জেল সুপার ২১ দিনের পূর্বে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয়-এমন সময়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষমতা পাবেন।

সাধারণ মামলায় বিচারিক আদালত কোনো আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে দণ্ডাদেশ কার্যকরের জন্য জন্য হাই কোর্টের অনুমোদন লাগে। এক্ষেত্রে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আপিলের সুযোগ পান।

তবে আপিল না করলেও ওই দণ্ড কার্যকরে হাই কোর্টের অনুমোদন লাগে। হাই কোর্টে নিষ্পত্তির পর আসামি আপিল বিভাগে লিভ পিটিশন দায়ের করতে পারেন।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল হাই কোর্টের সমমর্যাদার বলে এ আদালতের যে কোনো দণ্ডের বিরুদ্ধে উভয় পক্ষ সরাসরি আপিল বিভাগে যেতে পারেন।

সাধারণ ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে আবেদন না করলে হাই কোর্ট মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন দেওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডের প্রক্রিয়া শুরু হয়। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির রায় বিচারিক আদালতে পৌঁছানোর পর ওই আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে।

কারাবিধিতে বলা আছে, প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দির ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করার অধিকার থাকবে। এই সুযোগ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার জন্যও রাখা হয়।

কারাবিধি অনুসারে কোনো মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর জেল সুপার তা বন্দিকে জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়ে তার মত চাইবেন। সাত দিনের মধ্যে তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।

ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনে রাষ্ট্রপতি ও সরকার উভয়কে সম্বোধন করতে হবে। আবেদন পাওয়ার পর জেল সুপার তা স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে পাঠাবেন। সঙ্গে আলাদা চিঠিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সম্ভাব্য তারিখ এবং আসামির দণ্ডের বিষয়ও থাকবে।

জেল সুপারকে এর জবাব দেয়ার সর্বনিম্ন সময়সীমা কারাবিধিতে নেই। তবে সর্বোচ্চ ১৫ দিনেও তিনি জবাব না পেলে এ বিষয়ে আবারো সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। সরকারের আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা যাবে না।

দণ্ড কার্যকরে কারাবিধি মানার কথা বলা হলেও যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে তা পালন বাধ্যতামূলক নয় বলেই এর আগে মত দিয়েছিল সরকার। কামারুজ্জামানের মামলার ক্ষেত্রে রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকছে।

আপিল করার পর গত বছরের ১ এপ্রিল আপিল বিভাগে কাদের মোল্লার মামলার শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষ হওয়ার পর ২৩ জুলাই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে আপিল বিভাগ। পরে ১৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত রায়ে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ৫ ডিসেম্বর সেই রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়।

৮ ডিসেম্বর ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ট্রাইব্যুনালে পৌঁছানোর পর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়। যা পৌঁছে দেওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।

রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করতে অস্বীকার করায় ১০ ডিসেম্বর রাতে প্রস্তুতি নেওয়া হয় ফাঁসি কার্যকরের। স্বজনরাও দেখা করেন মিরপুরের কসাই নামে পরিচিতি কাদের মোল্লার সঙ্গে।

তবে এর মধ্যে আসামিপক্ষ রিভিউ এর আবেদন করলে রাতেই চেম্বার বিচারপতির আদালত থেকে ফাঁসি স্থগিতের আদেশ হয়। পরে দুইদিন পূর্ণাঙ্গ আদালতে শুনানি করে রিভিউ এর গ্রহণযোগ্যতা ও রিভিউ মঞ্জুরের আবেদন খারিজ করে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। যুদ্ধাপরাধ মামলায় প্রথম ব্যক্তি হিসাবে ওই রাতেই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

কামারুজ্জামানের মামলায় আপিল শুনানি ও রায়ের অপেক্ষার পর্যায়ে কাদের মোল্লার মামলার তুলনায় কম সময় লাগে।

একাত্তরে আলবদর বাহিনীর ময়মনসিংহ জেলা শাখা প্রধান কামারুজ্জামানকে গত বছর  ৯ মে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে গত ৫ জুন শুনানি শুরু হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়।

সোমবার সেই প্রত্যাশিত রায়ে ট্রাইব্যুনালের দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ, যার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায় যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ভাগ্য।  

গত ১৭ সেপ্টেম্বর আরেক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায় আসে। রায়ে তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়।