চূড়ান্ত রায়েও কামারুজ্জামানের ফাঁসি

সর্বোচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজা বহাল রাখায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিকাষ্ঠেই যেতে হবে জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2014, 03:13 AM
Updated : 4 Nov 2014, 05:15 AM

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ সোমবার এই রায় ঘোষণা করে।

বেঞ্চের বাকি সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও  বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

এমন এক দিনে আপিল বিভাগ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করল, যেদিন একই অপরাধে দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে হরতাল করছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী সংগঠনটি।  

একাত্তরে আল বদরের ময়মনসিংহ জেলা শাখা প্রধান কামারুজ্জামানকে গত বছর ৯ মে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে হত্যার ঘটনায় কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিল বিচারিক আদালত।

এর মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে হত্যার দায়ে আপিল বিভাগের চার বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে আসামি কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।

তবে চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফাকে হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আপিল বিভাগ।

এছাড়া যাবজ্জীবন ও ১০ বছর কারাদণ্ডের দুটি অভিযোগ বহাল এবং যাবজ্জীবনের একটি অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দিয়েছে আদালত। 

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে কামারুজ্জামান  হলেন তৃতীয়ব্যক্তি, আপিল বিভাগে যার মামলার নিষ্পত্তি হলো।

কাশিমপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর চল্লিশ নম্বর ফাঁসির সেলে কয়েদির পোশাকে বন্দি এই জামায়াত নেতা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের খবর শোনেন নিজের কাছে থাকা এক ব্যান্ডের রেডিওতে।

এ কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. জাহাঙ্গীর কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কারাগারে রায় শোনার পর বাহ্যিকভাবে তার মানসিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। খাওয়া-দাওয়াসহ তার আচরণ ছিল স্বাভাবিক; বিচলিত মনে হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন শেরপুরের কুখ্যাত আল বদর নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় বহাল থাকার খবর পেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শহরে বের হয় আনন্দ মিছিল। মিষ্টি বিতরণ করেন জেলা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। আনন্দ মিছিল হয় রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চেও।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শেরপুরের মোশারফ হোসেন তালুকদার মানিক, যার ভাই গোলাম মোস্তফাকে একাত্তরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে আলবদর বাহিনী।  

মানিক বলেন, “আমরা এ রায়ে খুশি। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার পেয়েছি। দেশ ও শেরপুরবাসী কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।”

সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকায় হতাশা প্রকাশ করে কামারুজ্জামানের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেছেন, তারা রিভিউ আবেদন করবেন।

অন্যদিকে এই রায়ে মানুষের মনে স্বস্তি এসেছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেছেন, রিভিউয়ের সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন না। 

নিয়ম অনুযায়ী, এখন আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলে তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। এরপর তা কার্যকর করবে সরকার। এক্ষেত্রে সরকার চাইলে কারাবিধিও (জেল কোড) অনুসরণ করতে পারে।

কারাবিধি অনুযায়ী প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ পাবেন। মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর জেল সুপার তা বন্দিকে জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়ে তার মত চাইবেন। সাত দিনের মধ্যে তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। 

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, “পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর তা জেলা প্রশাসকের কাছে যাবে। কারা কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে রায় কার্যকর করবে।”

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইতোধ্যে জানিয়েছেন, আইনি আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই সরকার রায় কার্যকর করবে।

এক্ষেত্রে কামারুজ্জামানের মামলার ক্ষেত্রে রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকছে। কিন্তু রিভিউ নিয়ে তার আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি এখনো প্রকাশিত না হওয়ায় এ ধরনের মামলায় রিভিউ কার্যকর হবে কি-না সে অস্পষ্টতা থাকছেই।

যে কারণে ফাঁসি

গত বছর ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ হয়। ১ ও ৭ নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন এবং ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আপিল বিভাগের রায়ে তৃতীয় অভিযোগে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামের হত্যাকাণ্ডে কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছেন চার বিচারক। তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। কোন বিচারক ভিন্ন সাজার পক্ষে বলেছেন, সংক্ষিপ্ত রায়ে তা জানা যায়নি।

একাত্তরে আলবদর নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পরিকল্পনায় ওই গ্রামের ১২০ জন পুরুষকে হত্যা ও বহু নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এরপর সোহাগপুর পরিচিত হয় ‘বিধবাপল্লী’ নামে।

আপিলের রায়ে চার নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে তিন নম্বর অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজার রায় আসায় এই জামায়াত নেতার ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ডই প্রযোজ্য হচ্ছে। 

এছাড়া ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন সাজা আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বহাল রেখেছে। একইভাবে ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ডও বহাল থাকছে।

প্রসিকিউশনের ১ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ থাকে খালাস দিয়েছে। 

পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে জানানো হয়েছিল। প্রসিকিউশনের আপিল না থাকায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। 

রিভিউ ‘জটিলতা’

সর্বোচ্চ আদালতে যুদ্ধাপরাধ মামলার তৃতীয় রায়ের পরও ফিরে এসেছে সেই রিভিউ বিতর্ক। আসামিপক্ষ রিভিউয়ের অধিকারের কথা বললেও রাষ্ট্রপক্ষ বলছে- সে সুযোগ নেই।

কামারুজ্জামানের আইনজীবী তাজুল ইসলাম ও তার ছেলে হাসান ইকবাল হোসেন দুজনেই বলেছেন, তারা রিভিউয়ের আবেদন করবেন।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আগের দুটি রায়ের মতোই বলেছেন, রিভিউ করার আর কোনো সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন না।

“এর আগে কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে রিভিউ করেছিল, তা খারিজ করে দেয় আদালত। এক্ষেত্রে রিভিউয়ের আর কোনো স্কোপ নেই।”

সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আসামিপক্ষ রিভিউ করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তাও নাকচ করে দেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “বিশেষ আইনে এ বিচার হচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে এ আইন প্রটেকটেড। ১০৫ আর্টিকেল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলেছিলাম, এখনও তা বলছি। কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, আর রিভিউ চলবে না।”

অন্যদিকে তাজুল ইসলাম বলেছেন, “রিভিউ সাংবিধানিক অধিকার। সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- রিভিউ মেনটেইনেবল না। কাদের মোল্লার রায়ের ক্ষেত্রেও রিভিউ করা হয়েছিল। সুতরাং রিভিউ নিষ্পত্তি করতে হবে। মেরিটেবল না হলে রিভিউ খারিজ হতে পারে।”

রিভিউ নিয়ে প্রথম জটিলতা দেখা দেয় আপিল বিভাগ ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে রায় প্রকাশ করলে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউয়ের সুযোগ চান কাদের মোল্লা। পাশাপাশি রায় রিভিউ করে খালাসও চান তিনি।

এ নিয়ে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার পক্ষে করা দুটি আবেদনই একসঙ্গে খারিজ করে দেয়। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনো প্রকাশিত না হওয়ায় এ ধরনের মামলায় রিভিউ চলবে কি-না, সে অস্পষ্টতা এবারও কাটেনি।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ বলেন, “রিভিউয়ের পর রায় কার্যকর হবে। এক্ষেত্রে রিভিউয়ের অধিকার সীমিত। রিভিউ করার সুযোগ যদি থাকে তারপরেই তা কার্যকর হবে।”

‘ন্যায়বিচার হয়নি’

ফাঁসি বহাল থাকায় ‘রিভিউ পর্যন্ত আইনি’ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী তাজুল ইসলাম।

আদালত প্রাঙ্গণে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আপিলেও ন্যায়বিচার পেলেন না কামারুজ্জামান।”

কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল হোসেন বলেন, “আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। আমরা এখন রিভিউ আবেদন করব।”

এই রায়কে ‘সরকারি ষড়যন্ত্র’ আখ্যায়িত করে বুধবারও হরতাল ডেকেছে কামারুজ্জামানের দল জামায়াতে ইসলামী।

দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান সোমবার এক বিবৃতিতে বলেন, “দেশবাসী আশা করেছিল মহামান্য সুপ্রিমকোর্টে তিনি ন্যায় বিচার পাবেন। আজ মাননীয় আদালতের প্রদত্ত রায়ে দেশবাসী হতাশ হয়েছে।”

‘পাপমোচন, কলঙ্কমোচন’

একাত্তরে বদর নেতা কামারুজ্জামানের নির্যাতন কেন্দ্রের দারোয়ান মোহন মুন্সী ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন।

রায়ের পর শেরপুরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “আল বদর হয়ে যে পাপ করেছিলাম এ রায়ের মধ্য দিয়ে আমার সে পাপ মোচন হলো। আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাই। রায়ে আমি খুব খুশি।”

আপিল বিভাগ রায়ের পর সংবাদ সম্মেলন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তিনি বলেন, “আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি। আমাদের জন্য পরম স্বস্তিদায়ক। মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে এতেই আমরা স্বস্তি পেয়েছি। সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর জনগণ, মুক্তিকামী মানুষ, যারা আইনের শাসন চান- তারা এবং ক্ষতিগ্রস্তরা এ রায়ে স্বস্তি পেয়েছে।”

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, “আপিলের রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ হলো ৪৩ বছরের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।”

আশাবাদী ছিলেন জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের আরেক প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ বলেন, এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

এই রায় প্রত্যাশিত ছিল বলেই মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তার ভাষায়, রায় যতো দ্রুত কার্যকর হবে, ততো দ্রুত দেশের মানুষ স্বস্তি পাবেন।

শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন এই রায়ের প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। বিশেষ করে স্বজনরা অপেক্ষা করে আছেন যে তাদের স্বজনদের হত্যার বিচার হবে। আমরা মনে করি এ রায়ে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”

মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়কদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

এখন রায় কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছেন জানিয়ে ফোরামের চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহ বলেন, “ফাঁসি কার্যকর হলেই শান্তি আসবে।”

বদর কমান্ডার থেকে শিবির সভাপতি

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলায় জন্ম নেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায়।

স্বাধীনতার পরের বছর ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে থেকে মাস্টার্স পাস করার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমনের আমলে ১৯৭৮-৭৯ সালে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৯ সালের অক্টোবরে কামারুজ্জামান মূল দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর রুকনের দায়িত্ব পান।

১৯৮২-১৯৮৩ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বেও ছিলেন। একসময়  জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য পদে থাকলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

১৯৯২ সাল থেকে তিনি দলে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে রয়েছেন।

ফাইল ছবি

 আলবদর বাহিনীর সংগঠক

এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মোহাম্মদ কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীকে সংগঠিত করেন বলে যে তথ্যপ্রমাণ প্রসিকিউশন উপস্থাপন করেছে- আসামির আইনজীবীরা তা খণ্ডাতে পারেননি।

“প্রসিকিউশন অভিযোগে বলেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পর পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে বৃহত্তর ময়মনসিংহে যে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়, কামারুজ্জামান ছিলেন তার ‘চিফ অর্গানাইজার’।”

এর পক্ষে প্রসিকিউটররা দৈনিক সংগ্রামের সেই সময়ের একটি প্রতিবেদনও উপস্থাপন করেন, যে পত্রিকাটি জামায়াতরে মুখপত্র হিসাবে পরিচিত।  

আর দল হিসাবে জামায়াতকেও যুদ্ধাপরাধে দায়ী করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সেই সময়ে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের ‘সন্ত্রাসী ও গুপ্তচর’ আখ্যায়িত করে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।  আর এ কাজে তারা ব্যবহার করে নিজেদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলবদর এবং জামায়াতকর্মীদের নিয়ে গঠিত রাজাকার বাহিনীকে।

“দেখা যায়, জামায়াতে ইসলামী এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনায় মূল ভূমিকা রাখে। আর আল বদর বাহিনী কাজ করে খুনে বাহিনী (ডেথ স্কোয়াড) হিসাবে।”

বিচার পরিক্রমা

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু প্রত্যাশিত বিচার কাজ শুরু হয়।

ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে একটি মামলায় একই বছর ২৯ জুলাই তাকে গ্রেপ্তারের পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ৪ জুন। প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৮ জন সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন পাঁচজন।

২০১৩ সালের ৯ মে হত্যা ও  নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। গত ৫ জুন এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় এ রায় হলো।

তৃতীয় রায়

ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত হওয়া ১১টি মামলার রায়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত সাতটিতে দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আবুল কালাম আযাদ এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় এ সুযোগ পাননি।

কামারুজ্জামানের মামলাসহ চূড়ান্ত রায় এসেছে তিন মামলায়। এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর  জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং তার ঠিক এক বছর আগে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। গত ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

আপিল শুনানি চলাকালেই মৃত্যু হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল বিচারাধীন।

[এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কাজী শাহরিন হক, মইনুল হক চৌধুরী, গোলাম মুজতবা ধ্রুব, সালাউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম, আশিক হোসেন, এহেছান লেনিন, মাহবুবা ডিনা, নাহিদ আশরাফী ও মহিউদ্দিন মুরাদ।]