কামারুজ্জামানের ফাঁসিই চান সোহাগপুরের বিধবারা

একাত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আলবদর প্রধান যুদ্ধাপরাধী মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়েও ফাঁসি ছাড়া অন্য কিছু ভাবছেন না সোহাগপুর পল্লীর বিধবারা।

আব্দুর রহিম বাদলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2014, 08:06 PM
Updated : 3 Nov 2014, 07:38 AM

শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের ওই বিধবারাই শুধু নন, একই চাওয়া কামারুজ্জামানের মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, ক্ষতিগ্রস্ত ও শহীদ পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধারা পুরো জেলার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষরা।

গত বছর ৯ মে হত্যা ও গণহত্যার দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

যে দুটি ঘটনায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়, তার মধ্যে একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোরে সোহাগপুর গ্রামের ১২০ জন পুরুষকে হত্যা ও গ্রামের নারীদের ধর্ষণের অভিযোগটি রয়েছে।

এক গ্রামে এক সঙ্গে এতজন পুরুষকে হত্যার পর গ্রামের অধিকাংশ নারীকে অকালে বৈধব্য নিতে হয়েছিল, যে কারণে সোহাগপুর ‘বিধবাদের গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।   

ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। সোমবার এই আপিলের চূড়ান্ত রায় হবে।

সোহাগপুরের বিধবা পল্লীর জড়িতন বেওয়া, হাসিনা বেওয়া ও হাজেরা বেওয়া চূড়ান্ত রায়ের আগেও কামারুজ্জামানের বদর বাহিনীর সেই পৈশাচিকতার বিবরণ দিতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

তারা রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ৪৩ বছর ধরে কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সোহাগপুরে নৃশংসতা ও স্বামী-সন্তানদের হত্যার হোতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় আপিলের চূড়ান্ত রায়েও বহাল থাকবে বলে তাদের আশা।

ফাইল ছবি

সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জালাল উদ্দিন বলেন, কামারুজ্জামানের নির্দেশে পাক হানাদার বাহিনী ও আলবদর-রাজাকাররা ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই সকালে সোহাগপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে আমার বাবা, জ্যাঠা ও ভাইসহ একই পরিবারের সাতজনকে এবং আরও অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে।

“শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে কামারুজ্জামানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আপিল আদালতেও বহাল থাকবে বলে প্রত্যাশা করছি।”

শহীদ গোলাম মোস্তফার ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার মানিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বড় ভাইকে কামারুজ্জামান নিজহাতে গুলি করে হত্যা করেছে। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে তা প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, সর্বোচ্চ আদালতের আপিলের রায়েও মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বহাল থাকবে।”

মুক্তিযোদ্ধা তালাপতুফ হোসেন মঞ্জু আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, নয়ানীবাজার নির্যাতন সেলসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মুক্তিকামী মানুষকে ধরে নিয়ে শেরী ব্রিজে হত্যা করে মৃগী নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিত কামারুজ্জামান।

“তার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ আপিলে বহাল থাকলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার আত্মা শান্তি পাবে।”

এই মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষী আত্মস্বীকৃত বদর বাহিনীর সদস্য মনোয়ার হোসেন খান ওরফে মোহন মুন্সি বলেন, “নির্যাতন ক্যাম্পের দারোয়ান হিসেবে কামারুজ্জামানের অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড সবকিছুই আমি দেখেছি। ভয়ভীতি সত্বেও ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছি।

“কামারুজ্জামানের ফাঁসি রায় আপিলেও বহাল থাকুক সেটাই আমার চাওয়া। কারণ কামারুজ্জামানের ফাঁসি হলে আমি বদর হয়ে যে পাপ করেছি সেই পাপমোচন হবে এবং আমার আত্মা শান্তি পাবে।”

আরেক সাক্ষী মজিবর রহমান খান পানু বলেন, “কামারুজ্জামান ও তার বদর বাহিনীর সহযোগীরা আমাকেসহ আরও অনেককে ধরে নিয়ে ঝিনাইগাতীর আহাম্মদ নগর পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায় । আমাকেসহ অন্যদের  লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছিল কামারুজ্জামান। অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছি।

“এব্যাপারে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিয়েছি। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় আপিলেও বহাল থাকবে বলে আমি আশা করছি।”

শেরপুর জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, “ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকুক আমি চাই এবং আমি মনে করি দেশবাসীও তাই চায়।”

এদিকে কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত রায়কে নিজ জেলা শেরপুরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শহরের বাজিতখিলাসহ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

ফাইল ছবি

কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালের ৪ জুলাই শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলায় জন্ম নেন। তার বাবা ইনসান আলী সরকার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে জামালপুরের আশেক-মাহমুদ কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা নেতাকর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি।

এই বাহিনী সে সময় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও টাঙ্গাইলে ব্যাপক মাত্রায় যুদ্ধাপরাধ ঘটায়।

জামালপুরে আলবদর বাহিনীর সাতটি ক্যাম্পের মধ্যে শেরপুরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়ি দখল করে বানানো ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কামারুজ্জামান। সে সময় বহু মানুষকে হত্যা করা হয় ওই ক্যাম্পে।