মীর কাসেমের ফাঁসির রায় যে দুই অভিযোগে

মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ আটজনকে হত্যার দুটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তখনকার আলবদর কমান্ডার ও জামায়াতের শুরা সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2014, 02:12 PM
Updated : 2 Nov 2014, 06:44 PM

তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন মানবতাবিরোধী অপরাধের যে ১৪টি অভিযোগ এনেছিল, তার মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়েছে সন্দেহাতীতভাবে।

১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ আংশিক প্রমাণিত হলেও হত্যায় সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ায় ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয়।    

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রোববার এই রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসান নিজেই ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়ে শোনান।

রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়েই সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। আর ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক কাসেম চট্টগ্রাম অঞ্চলে বদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তাও উঠে এসেছে এই রায়ে।

সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগের সবগুলোতেই অপহরণ করে নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে।   

এর মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেমকে ২০ বছর কারাদণ্ড, ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং বাকি ছয় অভিযোগের প্রতিটিতে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

তবে দুটি অপরাধে ফাঁসির রায় আসায় তার ক্ষেত্রে আর কারাদণ্ডের বিষয়টি কার্যকর হবে না। 

ট্রাইব্যুনাল রায়ে জানিয়েছে, মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। এসব অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রথম রায়

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর এটি ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একাদশ রায়।

আগের সবগুলো রায় সর্বসম্মতভাবে এলেও মীর কাসেমের রায়ে এসে একটি অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো অন্য দুজনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন এক বিচারক। 

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং দুই সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছেন যে, ১১ নম্বর অভিযোগে ছয়জনকে হত্যার সঙ্গে কাসেমের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে।

অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় মীর কাসেমের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে হত্যায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ (২) ধারা অনুযায়ী আসামিকে সর্বসম্মতভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।   

১২ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে দুই বিচারক একাত্তরে দুইজনকে হত্যার ঘটনায় কাসেমকে দোষী সাব্যস্ত করলেও বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া তাকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেন। 

অভিযোগ ১২: ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোনো একদিন মীর কাসেম আলীর পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা হিন্দু অধ্যুষিত হাজারি লেনের ১৩৯ নম্বর বাড়ি থেকে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং ১১৪ নম্বর বাড়ি থেকে রঞ্জিত দাস ওরফে লাঠুকে ও টুনটু সেন ওরফে রাজুকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। পরদিন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ছেড়ে দেওয়া হলেও লাঠু ও রাজুকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়। এই তিনজনকে অপহরণের সময় আলবদর বাহিনী এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেক দোকানপাট লুট করে এবং অন্তত আড়াইশ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এর ফলে অন্তত একশ’ হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।

এ ঘটনাতেও মীর কাসেমের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে হত্যার ঘটনায় দুই বিচারক আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করায় একজনের ভিন্নমতের পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ফাঁসির রায় এসেছে। 

দুই সাজা একসঙ্গেই কার্যকর হবে বলে রায়ে জানিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। 

বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড

মীর কাসেমকে ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

অভিযোগ ২: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯ নভেম্বর দুপুর ২টার দিকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনী লুতফর রহমান ফারুক ও সিরাজকে চাক্তাই এলাকার বকশিরহাটে জনৈক সৈয়দের বাড়ি থেকে অপহরণ করে। এরপর তাদের আন্দরকিল্লার মহামায়া হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়, যা সে সময় ডালিম হোটেল টর্চার সেল নামে পরিচিত ছিল এবং মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। পরে লুতফর রহমান ফারুককে বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের কর্মীদের বাড়িগুলো চিহ্নিত করিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফারুককে আরো দুই-তিনদিন ডালিম হোটেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে সার্কিট হাউজে নিয়ে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তুলে দেয় আলবদর। সেখানেও তার উপর নির্যাতন চালানো হয় এবং চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরে সেখান থেকে ছাড়া পান ফারুক।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইন  অনুযায়ী তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ৩: ওই বছর ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ডবলমুরিং থানাধীন কদমতলীতে তার বাসা থেকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে অপহরণ করে আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা। তাকে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে মীর কাসেমের উপস্থিতিতে নির্যাতন চালানো হয়। দেশ স্বাধীন হলে ১৬ ডিসেম্বর সকালে ডালিম হোটেল থেকে জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে তার আত্মীয় ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইন  অনুযায়ী তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর গভীর রাতে মীর কাসেম আলীর উপস্থিতিতে ডবলমুরিং থানাধীন আজিজ কলোনি থেকে সাইফুদ্দিন খানকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। সেখানে অন্যদের সঙ্গে তাকেও মারধর করা হয়। ডিসেম্বরের ২ অথবা ৩ তারিখে বন্দিদের চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়, সেখানে জেলারের মাধ্যমে সাইফুদ্দিনের স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করেন। স্বামীকে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। ১৬ ডিসেম্বর জেল থেকে ছাড়া পান সাইফুদ্দিন।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইন  অনুযায়ী তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ৬: নভেম্বরের ২৮ তরিখ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মীর কাসেমের নির্দেশে পাকিস্তানী সেনাদের সহায়তায় আলবদর সদস্যরা হারুন-অর-রশিদকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে চোখ ও হাত বেঁধে তাকে নির্যাতন করা হয়। পরে মীর কাসেমের নির্দেশে তাকে চোখ-হাত বাঁধা অবস্থাতেই পাঁচলাইশের সালমা মঞ্জিলে আরেকটি নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর সালমা মঞ্জিল থেকেই তাকে উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইন  অনুযায়ী তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ৭: একাত্তরের ২৭ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পরে মীর কাসেমের নির্দেশে ডবলমুরিং থানাধীন ১১১ উত্তর নলাপাড়া থেকে মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও ইলিয়াসকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।

সেখানে তাদের আটকে রেখে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। মীর কাসেমের নিয়ন্ত্রণে থাকা এ নির্যাতন কেন্দ্রে আটক থাকার সময় তারা আরো অনেককে আটক অবস্থায় দেখতে পান। এদের অনেককে আবার ডালিম হোটেল থেকে নিয়ে যেতে দেখেন তারা, এবং পরে শুনতে পান যে বদর বাহিনীর সদস্যরা তাদের মেরে ফেলেছে। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করার শর্তে মীর কাসেমের নির্দেশে ৬ ডিসেম্বর হাবিবুর রহমান এবং ৯ ডিসেম্বর মো. সানাউল্লাহ চৌধুরীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইন  অনুযায়ী তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ৯:  মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ২৯ নভেম্বর ভোরে মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে চাঁদগাঁও থানাধীন নাজিরবাড়ি এলাকা থেকে পাঁচ চাচাতো ভাইসহ নুরুজ্জামানকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা। সেখানে তাদের আটকে রেখে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরে তাদেরকে সেখান থেকে মুক্ত করা হয়।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইন  অনুযায়ী তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ১০: একাত্তরের ২৯ নভেম্বর ভোর ৫টার দিকে মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা নাজিরবাড়ি এলাকা ঘেরাও করে মো. জাকারিয়া, মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়া, ইস্কান্দর আলম চৌধুরী, মো. নাজিম উদ্দিনসহ আরো অনেককে অপহরণ করে এবং এনএমসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে যায়। পরে তাদের সবাইকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। বয়সে ছোট হওয়ায় নাজিমুদ্দিনকে পরদিন ছেড়ে দেওয়া হয়। সাত-আটদিন পর মো. জাকারিয়াকে, ১১ অথবা ১২ ডিসেম্বর মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সবশেষে ইস্কান্দর আলম চৌধুরী ১৬ ডিসেম্বর ছাড়া পান।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইন  অনুযায়ী তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ ১৪: নভেম্বর মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন নাজির আহমেদ চৌধুরী রোডে এ জে এম নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। একদিন গভীর রাতে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন আলবদর সদস্য ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে। তারা নাসিরুদ্দীন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় এবং সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। ১৬ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকে আরো এক-দেড়শ লোকের সঙ্গে নাসিরুদ্দীনকেও উদ্ধার স্থানীয়রা।

এ ঘটনায় মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইন  অনুযায়ী তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

চার অভিযোগে খালাস

প্রসিকিউশনের আনা ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মীর কাসেমকে এসব অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ১: প্রসিকিউশন বলেছে, একাত্তরের ৮ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী চাক্তাই সাম্পান ঘাট থেকে মো. ওমর-উল-ইসলাম চৌধুরীকে অপহরণ করে। তাকে কোতোয়ালি থানাধীন দোস্ত মোহম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ে চামড়ার গুদামে টর্চার সেলে এবং পরে পাঁচলাইশ থানাধীন আসাদগঞ্জের সালমা মঞ্জিলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে ১২ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে একটি গাড়িতে করে তাকে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জোর করে সাদা কাগজে সই নিয়ে তার মামার কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়।

এই ঘটনায় কাসেমের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন, যা প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে বলা হয়েছে।

অভিযোগ ৫: অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর দুপুর আড়াইটার দিকে মীর কাসেম আলীর নির্দেশে রাজাকার কমান্ডার জালাল চৌধুরী ওরফে জালাল জল্লাদ নন্দন কানন এলাকার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সামনে থেকে আব্দুল জব্বার মেম্বারকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ১৭/১৮ দিন আটকে রেখে হাত ও চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের সময় পানি খেতে চাইলে তাকে প্রসাব খেতে দেয়া হয়, এর ফলে তিনি অন্য খাবার খেতে পারতেন না। ১৩ ডিসেম্বর মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

এই ঘটনায় কাসেমের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন, যা প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে বলা হয়েছে।

অভিযোগ ৮: প্রসিকিউশনের অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর রাত আড়াইটার দিকে মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা চাঁদগাঁও থানাধীন সাবহানঘাটা মহল্লা ঘেরাও করে নুরুল কুদ্দুস, মো নাসির, নুরুল হাসেমসহ আরো কয়েকজনকে অপহরণ করে এনএমসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে যায়। পরে ভোর বেলায় ওই তিনজনসহ আরো অনেককে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনজনকে দশদিন আটক রেখে নির্যাতন করা হয় এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ১৬ ডিসেম্বর তারা ছাড়া পান।

এই ঘটনায় কাসেমের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন, যা প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে বলা হয়েছে।

অভিযোগ ১৩: অভিযোগে বলা হয়,নভেম্বরের কোনো একদিন আন্দরকিল্লার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার গোলাম মোস্তফা কাঞ্চনের বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে ফিরছিলেন সুনীল কান্তি বর্ধন ওরফে দুলাল ও তার স্ত্রী, ছেলে ও একজন কিশোর গৃহকর্মী। পথে চাক্তাই সাম্পানঘাটে পৌঁছালে মীর কাসেমের নির্দেশে দুলালকে অপহরণ করে চাক্তাইয়ের দোস্ত মোহম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরো অনেক সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় দুলালকে। পরে ১৪ ডিসেম্বর তাদের সবাইকে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকে দুলালকে উদ্ধার করা হয়।

এই ঘটনায় কাসেমের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন, যা প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে বলা হয়েছে।

গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের এ ১৪টি ঘটনায় অভিযুক্ত করে মীর কাসেম আলীর বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। সাক্ষ্য, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে চলতি বছর ৪ মে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।