বিদ্যুত বিপর্যয়ে দুর্ভোগ সর্বত্র

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে রাজধানীসহ সারাদেশ কার্যত্র অচল ছিল প্রায় আট ঘণ্টা। কল-কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে রোগীদের পড়তে হয়ে দুর্ভোগে, নগরবাসীকে পড়তে হয় পানির ভোগান্তিতে।

সাজিদুল হকনুরুল ইসলাম হাসিব, শেখ আব্দুল্লাহ, মিন্টু চৌধুরী, , কাওছার হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2014, 01:18 PM
Updated : 2 Nov 2014, 04:00 PM

জাতীয় গ্রিড লাইনে ত্রুটির কারণে শনিবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানে বিদ্যুৎ ছিল না।

ত্রুটি মেরামতের পর সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ আসতে শুরু করে, মধ্যরাতে অধিকাংশ স্থানে বিদ্যুৎ পৌঁছে যায়।মানুষের জীবনযাত্রায় ফিরে আসে স্বাভাবিকতা। 

বিদ্যুৎ না থাকায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ ছিল হাসপাতালের রোগীদের। জেনারেটর দিয়ে জরুরি কাজ সারা গেলেও চিকিৎসাধীন রোগীদের হাঁসফাস করতে হয় গরমে।

বিদ্যুৎ যাওয়ার পর নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে কিছু কারখানায় কাজ চললেও কয়েক ঘণ্টা পর তা আর অব্যাহত রাখা যায়নি। অধিকাংশ কারখানায়ই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পকেও বিদ্যুৎ না থাকার এই দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।

বিদ্যুৎ যাওয়ার পর দু/এক ঘণ্টা কাজ চললেও তারপর অধিকাংশ পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয় বলে তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদ্যুৎ না থাকার বিষয়ে আমরা অভ্যস্ত। তবে আজকের মতো অবস্থা অতীতে হয়নি। তাই তা মোকাবেলার প্রস্তুতি কোনও কারখানার ছিল না।”

এ অবস্থায় অনেক কারখানাই দুপুরের দিকে ছুটি ঘোষণা করা হয় জানিয়ে আজিম বলেন, “যে সব কারখানায় কাল-পরশু শিপমেন্ট ছিল, তারাই বিকল্প ব্যবস্থায় কারখানা চালু রাখতে বাধ্য হয়েছে।”

চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কর্ণফুলী ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক খুরশীদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা রেশনিং করে কারখানাগুলোতে উৎপাদন চালিয়ে গিয়েছিলেন।

তবে বিজিএমইএ চট্টগ্রামের পরিচালক ও নগরী মুরাদপুর এলাকার একটি গার্মেন্টস কারখানার মালিক এমডিএম ওয়াহাব বলেন, ইপিজেডের বাইরের কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের মারাত্মক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে ছোট কারখানাগুলো উৎপাদন চালু রাখতে না পারায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

কারখানার পাশাপাশি কাজ বন্ধ হয়ে যায় প্রকাশনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও।

রাজধানীর বাংলাবাজারের টাইমস পাবলিকেশন্সের মালিক আবু নাঈম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদ্যুত না থাকায় কম্পোজ, প্রিন্টিং, বাইন্ডিংয়ের কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে এই অবস্থা।”

বিদ্যুতের অভাবে পাম্প না চলায় পানির ভোগান্তিতে কাবু হতে হয়েছে নগরবাসীকে। সন্ধ্যার পর রাজধানী অন্ধকারে ডুবে গেলে মোমবাতির চাহিদা বেড়ে যায়। তখন ৫ টাকার মোমবাতি ১৫ টাকায়ও কিনতে হয়েছে অনেককে।

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

যাদের বাড়িতে জেনারেটর রয়েছে, তা সচল রাখতে বিদ্যুৎহীন সময়টাতে পেট্রোল পাম্পগুলোতে দেখা গেছে ডিজেল কেনার দীর্ঘ লাইন।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আফসানা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুরের পর থেকে বাসায় পানি নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, বিদ্যুত না থাকায় ওয়াসার স্থানীয় পাম্প থেকে পানির সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।”

মিরপুর-১০ এলাকার বাসিন্দা শিরীন সুলতানা বলেন, “পানির সমস্যার কারণে বাসার দৈনন্দিন কাজে খুব অসুবিধা হচ্ছে।”

মহাখালীর হোটেল ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান বলেন, “দুপুর পর্যন্ত পানি কিনে হোটেলে রান্নার কাজ চালিয়েছি। কেনা পানি দিয়ে কতক্ষণ চালাব?” 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগীদের গরমে হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একই দুর্দশা দেখা যায়।

প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া অন্য সব সেবা বন্ধ হয়ে যায় বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জেনারেটর দিয়ে দুপুর ২টা পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটার চালু রাখা হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।

ওই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া ছাড়া আর কোনও সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না বলে জানান শেবাচিমের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রিয়াজুল ইসলাম।

রোগীরা জানান, বিদ্যুৎ না থাকায় লিফট বন্ধ ছিল। ফলে তাদের কষ্ট করেই সিঁড়ি বেড়ে উঠতে হয়েছে।

শেবাচিমের জেনারেটরের তত্ত্বাবধানকারী গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-বিভাগীয় সহকারী আবু সুফিয়ান বলেন, জেনারেটরটি একটানা বেশিক্ষণ চালালে কারিগরি সমস্যা দেখা দেয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে আইসিইউ, সিসিইউ ও পোস্ট সিসিইউ ইউনিটের কাজ চালানো হয় বলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদুল গণি জানান।

ছবি: সুমন বাবু/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

সাধারণ ওয়ার্ডগুলোতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। কয়েকটি ওয়ার্ডে গরমে রোগীদের হাঁসফাঁস করতে দেখা গেছে।

শহিদুল গণি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটু সমস্যা তো হচ্ছেই। জেনারেটর আর কত সময় চলবে তা বলতে পারছি না।  এভাবে বেশি সময় চালানো হয়ত সম্ভব হবে না।  ”

চট্টগ্রাম নগরীর দু-একটি বেসরকারি হাসপাতালের পরিস্থিতি জানতে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার দাবি করেছেন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, বিদ্যুৎ না থাকায় পরীক্ষা নিরীক্ষাসহ স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

রাজধানীর মিডফোর্ড হাসপাতালের নিজস্ব জেনারেটর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।তবে নিজস্ব জেনারেটর না থাকায় দুর্ভোগে পড়েন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা।

পঙ্গু হাসপাতালের অনুসন্ধান বিভাগের কর্মকর্তা কালাম পাটোয়ারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় এখানকার রোগীদের খুব সমস্যা হচ্ছে। আমাদের এখানে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেই।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল মজিদ ভূইয়া বলেন, তারা নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় কার্যক্রম সচল রেখেছিলেন।

রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন কেপিআইভুক্ত হওয়ায় বিশেষ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল। তবে সেখানকার কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতারে বিশেষ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

সৌর বিদ্যুৎ ও নিজস্ব জেনারেটর থাকায় রেলে সিগন্যাল কার্যক্রমে কোনও সমস্যা হয়নি বলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক তাফাজ্জল হোসেন জানিয়েছেন। তবে বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানো ট্রেনগুলোতে পানি সরবরাহ করায় সমস্যার কথা স্বীকার করেন তিনি।

চট্টগ্রামে কর্তব্যরত পূর্ব রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, “বিদ্যুৎ না থাকায় ম্যানুয়ালি জ্বালানি সরবরাহ করতে হয়েছে। এতে বেশি সময় লাগছে। আর টিকিট বিক্রিও ধীর গতিতে করতে হচ্ছিল।”

চট্টগ্রাম বন্দরের উপ-সংরক্ষক ক্যাপ্টেন নাজমুল আলম বলেন, বন্দরের পণ্য ওঠানামা ও অটোমেশন কার্যক্রমে কোনও ব্যাঘাত হয়নি। সব কাজ স্বাভাবিকভাবে চলেছে।

নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বড় বিপণি বিতানগুলো সচল থাকলেও অনেক দোকানই সন্ধ্যার পর অন্ধকার দেখা গেছে।