এখন নিজেই ছবির ফ্রেমে

যে প্রদর্শনী উদ্বোধন করার কথা ছিল এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদের, সেই প্রদর্শনীতে স্থান পেল তারই ছবি; আর নিজের তোলা সেই ছবি দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না সাঈদা খানম।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2014, 05:38 PM
Updated : 23 Oct 2014, 08:32 PM

বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পথচলার অষ্টম বার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রয়াত অধ্যাপকের ছবির সামনে এসে কেঁদে ফেলেন বাংলাদেশের প্রথম এই পেশাদার আলোকচিত্রী।

নিজেদের আট বছরের পথচলায় সময়ের এই গণ্ডির মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল সব ছবি নিয়ে সাজানো এই প্রদর্শনী অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদের উদ্বোধনের কথা ছিল, কিন্তু রোববার তার প্রয়াণ ছেদ ঘটায় এই পরিকল্পনায়।  

‘ফ্রেমবন্দি বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। একই অনুষ্ঠানে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোকচিত্র বিষয়ক নতুন ওয়েবসাইট click.bdnews24.com  উদ্বোধন করেন অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীনের স্ত্রীর বোন সাঈদা খানম।

বরেণ্য এই ইতিহাসবেত্তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে প্রদর্শনীর একটি অংশ, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘এ এফ সালাহ্উদ্দীন আহমদ কর্নার’।

সেখানে গিয়ে নিজের তোলা সালাহ্‌উদ্দীন আহমদের পারিবারিক ও কর্মমুখর জীবনের ছবিগুলোতে তাকাতেই চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ল ৭৭ বছর বয়সী সাঈদা খানমের।

ছবিগুলো দেখামাত্রই তিনি বলে উঠলেন, “আরে এতো আমার তোলা ছবি।”

অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে ভগ্নিপতিকে নিয়ে স্মৃতিচারণও করেন সাঈদা খানম।

“উনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। খুব স্নেহ করতেন। উনি আর আপা বিদেশে গেলে আমার জন্য ভালো ক্যামেরা কিনে আনতেন।”

সেই সময়ে ছবি তোলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, “পাকিস্তান আমলে আমার তোলা স্নানসিক্ত একটি মেয়ের ছবি ছাপা হয়েছিল বেগম পত্রিকায়। তখন এর বিরোধিতা করে মহল্লার লোকেরা এসে আমাদের বাড়ি ঘিরে ধরেছিল। সালাহ্‌উদ্দীন ভাই তাদের বুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন।”

সাঈদা খানম পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার পেছনেও সালাহ্‌উদ্দীন আহমদের অবদান স্মরণ করেন।

“২০০১ সালে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে আমার কাজের ওপর কলকাতার নন্দনে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল। তখন উনি (সালাহ্‌উদ্দীন আহমদ) অনেক সহায়তা করেছিলেন। উনি না হলে ওইটা হত না।”

“আবার উনার আদর্শ কিংবা বিভিন্ন বই নিয়ে আমরা অনেক প্রশ্ন করতাম। সুন্দর করে উনি আমাদের বুঝিয়ে দিতেন।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঘুরে ফিরেই আসে সালাহ্‌উদ্দীন আহমদ প্রসঙ্গ। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

এরপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যে প্রয়াত এ বুদ্ধিজীবীকে স্মরণ করেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

এত নিষ্কলুষ, এত পরিচ্ছন্ন, নিজের কাজের প্রতি এত অঙ্গীকারবদ্ধ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। প্রায় এক শতকজুড়ে তিনি আমাদের দিয়েই গেছেন।”

“শোক নয়, আমরা তার বর্ণাঢ্য জীবন স্মরণ করতে চেয়েছি, ” বলেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

শিক্ষকদের শিক্ষক সালাহ্‌উদ্দীন আহমদের জীবন নিয়ে অনুষ্ঠানে আলোকপাত করেন তারই ছাত্র অধ্যাপক আফসান চৌধুরী।

“তাকে আমি পেয়েছি বিভিন্নভাবে। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সম্পাদনার সময় সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। এরকম নম্র, ভদ্র মানুষ আমি আর দেখিনি।”

আফসান চৌধুরী বলেন, “উনি উনিশ শতকের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন; রাজা রামমোহন রায়ের ভক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট মতাদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

“তিনি ছিলেন প্রচণ্ডভাবে ধর্মমুক্ত একজন মানুষ; যে কারণে মওলানা ভাসানীর প্রতি আগ্রহ ছিল না তার।”

সালাহ্উদ্দীনের ‘স্যোশাল আইডিয়াজ অ্যান্ড স্যোশাল চেইঞ্জ’কে ইতিহাসের সেরা বই বলে অভিহিত করেন তার ছাত্র।

প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও স্মরণ করেন প্রয়াত ইতিহাসবিদকে।

“তার সঙ্গে আমার অনেকগুলো স্মৃতি রয়েছে। স্বাধীনতার আগে কূটনীতিক হিসেবে যখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম তখনই তার লেখার সঙ্গে আমার পরিচয়। ১৯৭৫ সালে যখন ঢাকায় ফিরে আসি তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয়।”

“আশির দশকের এরশাদের শাসনামলে আমি যখন চীনে ছিলাম। তখন তিনি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে পিকিং গেলে নতুন করে আলাপ হয়।”

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত সেপ্টেম্বরে ঢাকার অনুষ্ঠানে সালাহ্‌উদ্দীন আহমদের মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার স্মৃতিচারণও করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে সাবেক কূটনীতিক ও কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমেদও ছিলেন, অধ্যাপক সালাহ্‌উদ্দীন আহমদের সঙ্গে যার অনেক স্মৃতি রয়েছে।

“১৯৯১ সালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করতে গিয়ে। ইতিহাসবিদ হিসেবে মুক্তমনা মানুষ ছিলেন। তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অনুসারী ছিলেন এবং ইতিহাসবিদ হিসেবে ছিলেন মুক্তমনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার ঝোঁক ছিল অসামান্য।”

“তিনি ছিলেন জাতীয় ইতিহাসের সিম্বল। এ ধরনের মানুষ এখন আর দেখা যাচ্ছে না।”

সালাহ্‌উদ্দীন আহমদ বিডিনিউজ টোযেন্টিফোর ডটকমে নিয়মিত লিখতেন। আগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানগুলোতেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রদর্শনীস্থল গুলশানের বে’স গ্যালারিয়াতে তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে একটি অংশ। প্রদর্শনীস্থলে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে সালাহ্‌উদ্দীন আহমদকে শ্রদ্ধাঞ্জলির প্রতিকৃতি। তার বা পাশের কক্ষটিই এ এফ সালাহ্‌উদ্দীন আহমেদ কর্নার।

তরুণ বয়সে কেমন ছিলেন এই শুদ্ধসারথি- সাদাকালো ছবিতে তার দেখা মিলবে আগামী পাঁচ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী চলার পুরোটা সময়। সেইসঙ্গে অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তার ফ্রেমবন্দি হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের এই শিক্ষকের পারিবারিক জীবনও উঠে এসেছে প্রদর্শনীতে।