একজন সংশপ্তক

বাঙালির স্বাধীনতার সোপান রচিত হয় যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই ভাষা আন্দোলনের সফলতা থেকে পেয়েছিলেন মুক্তির সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। আমৃত্যু সেই সংগ্রামে অবিচল থেকে বলে গেছেন শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজের কথা।

আজিজ হাসানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2014, 12:27 PM
Updated : 8 Oct 2014, 02:41 PM

ভাষা আন্দোলন থেকে যুক্তফ্রন্ট, ফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়। শৃঙ্খল ভাঙার গানে উজ্জীবিত অনেক ছাত্র-যুবার কাছে তখন প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়- আবদুল মতিন ছিলেন তাদেরই একজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন মতিন, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তার আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৫২ সালে তুমুল আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তাদের সেই আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি পায় মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। 

এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে কারাগারে নানা বন্ধুর সাহচর্যে নতুন আদর্শে দীক্ষা- সে আদর্শ সমাজবদলের, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার। এ স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে জেল-জুলুম নির্যাতন কোনো কিছুতেই বিচ্যুত হননি মতিন।

৮৮ বছর বয়সে বুধবার চিরবিদায় নিয়েছেন এই আজীবন সংগ্রামী, তার দেখা স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই।

মৃত্যুর আগে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য দিয়ে গেছেন নিজের দেহ; আর কোনো দৃষ্টিহীনের জগত আলো করতে দান করে গেছেন চোখ দুটিও।

বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়েও থেমে থাকেনি তার চলার পথ। শেষ বয়সেও তিনি ছুটে গেছেন সাংস্কৃতিক মিলনমেলা বইমেলায়; যুদ্ধাপরাধের ফাঁসির দাবিতে সমবেত লাখো ছাত্র-জনতার মাঝে এসে দিয়ে গেছেন অনুপ্রেরণা। সব সময় বলে গেছেন সমতার কথা-নিজের ভাষার মর্যাদায় পাশাপাশি সব জাতিসত্ত্বার ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও সোচ্চার ছিলেন ভাষা সংগ্রামী মতিন।

জাতিসত্ত্বার দাবিদার বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের মাতৃভাষা যেমন বাংলা তেমনি তাদেরও স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। এ ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। জাতি হিসাবে তাদের টিকে থাকার সুযোগ দিতে হবে।”

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ সময় পরও সর্বস্তরে বাংলা চালু না হওয়ায় ক্ষোভ ছিল আবদুল মতিনের।

“যে ভাষার জন্য সংগ্রাম হলো, জীবন দিতে হলো সেই বাংলা এখনও সর্বস্তরে চালু হয়নি- এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, বাঙালিদের ভালো করে ইংরেজি শিখতে হলেও বাংলা জানতে হবে। কারণ ভালো বাংলা ছাড়া ভালো ইংরেজিও শেখা যাবে না,”  কয়েক বছর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন তিনি।

সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালুর জন্য কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব ছিল তার।

২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তন বক্তৃতায় আবদুল মতিন বলেন, “সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভাষাবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনের দেওয়া রিপোর্ট ও সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।”

ভাষা শহীদদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়ারও দাবি তুলেছিলেন তিনি।

“১৯৫২ এ সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক রক্ত দিয়েছিলেন। তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া উচিত। শহীদদের সম্মানিত করার অর্থ জাতিকে, আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে সম্মানিত করা,” ওই বক্তৃতায় বলেছিলেন আবদুল মতিন।

ভাষা আন্দোলনের পর ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা এবং তারপরে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সম্পৃক্ততা থেকে সারাজীবন রাজনীতির সঙ্গে কাটালেও মতিন ভাষা আন্দোলনকেই জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন তার এক ঘনিষ্ঠজন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১১তম জন্ম বার্ষিকীতে মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ঢাকা, মে ২৫, ২০১০

তার সহযোদ্ধা ও বন্ধু কবি আহমদ রফিকের এক লেখায় বলা হয়েছে, “মতিন নিজেই অনেকবার বলেছেন- ‘আমার রাজনৈতিক জীবনে সাফল্য একটাই, আর তাহলো একুশের ভাষা আন্দোলন’।”

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সালাম, রফিক, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকে। এর পর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পায়।

পরবর্তী জীবনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ‘সফলতা’ না এলেও নিরাশ হননি সংগ্রামী আবদুল মতিন-তরুণ প্রজন্ম দেশকে এগিয়ে নেবে বলে বিশ্বাস করতেন তিনি।

“আমরা ১৯৫২ সালে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, ১৯৭১ সালে যে স্বপ্ন বুকে ধারণ ও লালন করেছিলাম,তা আজও  পূরণ হয়নি। আজকের তরুণ ছাত্ররাই পারে সেই অপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। তার জন্য দরকার অবারিত দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ,” বলে গেছেন তিনি।

জীবনের শেষভাগে তরুণদের সংঘবদ্ধতা দেখে উচ্ছ্বসিত হন আবদুল মতিন। যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা আন্দোলনে হাজির হয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমি অভিভূত। এটা সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ।”

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তরুণদের সাহস যুগিয়ে সেদিন তিনি বলেন, “সেই বৃটিশ আমল থেকে অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্রের জন্য আমরা আমরা তিল তিল করে রক্ত দিচ্ছি। শাহবাগের এ গণজাগরণে আমরা ভাষাসৈনিকরাও আপনাদের পাশে আছি।”

শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর কাছ থেকে মাদার তেরেসা গোল্ড মেডেল ২০০৯ পুরস্কার নিচ্ছেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। ছবি: নাসিরুল ইসলাম/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ঢাকা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০০৯

রোববার রাজধানীর রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন ও অভিনেতা খন্দকার গোলাম কাদেরকে সংবর্ধনা দেয় বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদ। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ ঢাকা, মার্চ ১৫, ২০০৯

১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ধুবলিয়া গ্রামে কৃষক আব্দুল জলিল ও আমেনা খাতুনের ঘরে জন্ম হয় মতিনের। মাত্র আট বছর বয়সে ১৯৩৩ সালে মাকে হারান তিনি। জীবিকার তাগিদে বাবা ভারতের দার্জিলিং যাওয়ার সুবাদে সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মতিনের।

১৯৩৬ সালে দার্জিলিং সরকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। ওই বছর রাজশাহী সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে এইচএসসি পাসের পর ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টসে ভর্তি হন মতিন।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ভাষার দাবিতে বাঙালির আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন আবদুল মতিন।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৪৫ সালে। ভাষা আন্দোলনের পর তিনি ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং পরে সংগঠনটির সভাপতি হন। এরপর কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হন।

১৯৫৪ সালে পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হন মতিন। মওলানা ভাসানী ‘ন্যাপ’ গঠন করলে তিনি ১৯৫৭ সালে তাতে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে মতিন ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল )’ গঠন করেন।

চীনকে অনুসরণকারী বামপন্থি দলগুলোর নানা বিভাজনের মধ্যেও আবদুল মতিন সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতে। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রশ্নে চীনপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোতে অবস্থানের ভিন্নতা দেখা গেলেও মতিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন বলে তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চীনপন্থিরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিল। ১৯৯২ সালে কয়েকটি দলকে এক করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন আবদুল মতিন। তিনি জাতীয় কৃষক সমিতির সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন।

২০০৬ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ২০০৯ সালে হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন) গঠিত হলে আবদুল মতিন তাদের সঙ্গে যোগ দেন। সর্বশেষ বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি।

ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তার রচিত বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘বাঙালী জাতির উৎস সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন’, ‘ভাষা আন্দোলন কী এবং কেন’ এবং ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘জীবন পথের বাঁকে বাঁকে’।