হালদায় বিপন্ন মা মাছ

নির্বিচার শিকার, ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল ও আইন প্রয়োগে শিথিলতায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে মা মাছ।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2014, 06:21 AM
Updated : 6 Oct 2014, 06:21 AM

হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার পর থেকে নদীতে পাহারা চলছে সপ্তাহে মাত্র একবার। এতে মা মাছের টিকে থাকার ঝুঁকি বাড়ছে দিন দিন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মা মাছ কমে যাওয়ায় প্রতিবছরই ডিম ও রেণু উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই কার্প জাতীয় মাছের উৎস এই নদী থেকে ডিম আহরণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।   

হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মচারীরা নৌকা ভাড়া করে পাহারা দিলেও রাতের আঁধারে মাছ শিকার থামানো যাচ্ছে না। ইঞ্জিন বোটের আঘাতে প্রায়ই আহত হয়ে মারা যাচ্ছে মাছ।

চোরা শিকারিরা তৎপর

হালদার ডিম আহরণকারীরা ভাসা জাল দিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাছের ডিম সংগ্রহ করলেও শিকারিরা হাত জাল, ঘের জাল, ভাসা জাল, কারেন্ট জাল ও বড়শি দিয়ে নির্বিচারে মারছে মা মাছ।

হাটহাজারী গড়দুয়ারা এলাকার ডিম আহরণকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে রাতে ভাসা জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। ৪০ বছর ধরে আমি নদীতে ডিম আহরণ করি। ডিমের পরিমাণ প্রতিবছর কমছে।”

তিনি জানান, হালদার নদীর রাউজানের পশ্চিম নোয়াজিশপুর, নদীমপুর, গহিরা, কোতোয়ালি ঘোনা, পশ্চিম বিনাজুরি, কাগতিয়া, গোলজার পাড়া, আজিমের ঘাট, মগদাই, আবুর খীল এবং হাটহাজারীর নাঙ্গলমোড়া, ছিপাতলী ও গড়দুয়ারা নাপিতের ঘাট পয়েন্ট মাছ শিকার করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত শনিবার রাতেও রাউজানের নদীমপুরে জাল বসানো হয়েছিল মাছ শিকারের জন্য। সরকারি ছুটির দিন থাকায় অভিযান চালানো হবে না- এ বিষয়টি মাথায় রেখে সুযোগ কাজে লাগায় চোরা শিকারিরা।

গত ১৫ জুলাই ১৫ কেজি ওজনের একটি মা কাতলা মাছ ধরা পড়ে এ নদীতে। একজন স্থানীয় বাসিন্দা মাছটির ছবি দিয়ে হালদা রিভার ডট ওআরজি ওয়েবপেইজে মা মাছ রক্ষার আকুতি জানান।

উপজেলার স্থানীয় বাজারগুলোতে পুলিশি অভিযানের কারণে ধরা পড়া মা মাছ নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম নগরীর বাজারে।

চলতি বছরের ৩০ মে নগরীর কাজীর দেউড়ি বাজারে বিক্রি হয় হালদা থেকে ধরা ২০ কেজি ওজনের মা কাতলা মাছ। এর আগে ২৫ মে বিক্রি হয় ১৪ কেজি ওজনের আরেকটি কাতলা।

৩১ মে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া ২০ কেজি ওজনের মাছটির পেটে ছিল দুই কেজি একশ গ্রাম ডিম।

এ ঘটনাগুলো চলতি বছরের। তবে রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে গত ছয় বছরে মাত্র তিনটি মৃত মাছ উদ্ধারের তথ্য আছে।

মাত্র একশ  মা মাছ

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়ার মতে ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হালদায় বড় আকারের মা মাছ আছে মাত্র একশর মতো।  

মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হালদার ঘোলা পানির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আন্ডার ওয়াটার ক্যামেরা ব্যবহার করে মাছের সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

“আবার ট্যাগিং পদ্ধতিতে জরিপ করতে হলে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরে ট্যাগ লাগাতে হবে। এতে মা মাছ বিরক্ত হয়ে নদীর প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে।”

মনজুরুল কিবরিয়া তাই গত এক দশকে ডিম ছাড়ার পরিমাণ থেকে ব্যাক ক্যালকুলেশন পদ্ধতিতে মা মাছের সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন বলে জানান। 

তিন বছর বয়সের পর থেকেই মাছকে মা মাছ হিসেবে গণ্য করা হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মা মাছের ওজন ও দেয়া ডিমের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

ছয় থেকে সাত বছর বয়সী মা মাছের ওজন হয় ১৫ থেকে ২০ কেজি হয়। আট থেকে দশ বছর বয়সী মাছ হয় ২৫ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত।

প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক মা মাছ যে ডিম দেয় তা থেকে রেণু হয় চার থেকে ছয় কেজি।

সরকারি হিসাবে, ২০১২ সালে নদী থেকে সংগৃহীত ডিমে রেণু হয়েছিল প্রায় এক হাজার ছয়শ কেজি। ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬২৪ কেজিতে। সবশেষ ২০১৪ সালে এ পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র পাঁচশ কেজিতে।

মনজুরুল কিবরীয়া জানান, ডিম ছাড়ার পরিমাণ হিসাব করলে বড় আকারের (তিন বছরের বেশি বয়সী) মা মাছ আছে মাত্র একশর মতো। অথচ থাকার কথা ছিল এক হাজারের কাছাকাছি।

“নদী নিয়ে নানা প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জেনেছি। কিন্তু নদীতে মা মাছ না থাকলে শত কোটি টাকার এসব প্রকল্প পানিতেই ভেসে যাবে। এভাবে মা মাছ কমলে কয়েক বছর পর হয়ত আহরণ করার মতো ডিমও পাওয়া যাবে না,” বলেন তিনি।  

সংখ্যার বিচারে মনজুরুল কিবরিয়া পুরোপুরি একমত না হলেও রাউজান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, মা মাছের সংখ্যা কমেছে।

মাছের সংখ্যা নির্ধারণে জরিপের একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে বলে তিনি জানান।

ভাড়ার নৌকায় সাপ্তাহিক প্রহরা 

নির্বিচারে মাছ শিকার চললেও নদীসংলগ্ন রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার মৎস্য অধিদপ্তর ‘ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার’ যেন।

মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ অনুসারে হালদা নদীর নাজিরহাট ব্রিজ থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকায় মাছের অভয়ারণ্যে সারা বছর মাছ শিকার নিষেধ।

হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্পের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তর এ এলাকায় মা মাছ ধরা ও যান্ত্রিক নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করে।

এ আইন অনুসারে হালদা নদীর সংযুক্ত ১৭টি খালে প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ।

এ আইন অমান্যকারীদের এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

প্রকল্পটি চলাকালে দুই উপজেলায় আট জন করে আনসার সদস্য নদীতে টহল দিত। গত জুনে প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির মেয়াদ শেষের পর নিরাপত্তায় আনসার সদস্যরা আর নেই।

রাউজান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন আরো জানান, দুই উপজেলার কার্যালয়ের কর্মচারীদের নিয়ে নৌকা ভাড়া করে সপ্তাহে একবার টহল দেয়া হয়। আবার স্থানীয়রা জাল পাতার খবর দিলেও অভিযান চালানো হয়।

ইঞ্জিন বোটের আঘাতে মাছ মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।

নদীতে মা মাছ শিকারের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে নাজিম উদ্দিন বলেন, “রাউজান অংশে ইতিমধ্যে রুই জাতীয় মাছের ডিম কমে গেছে। তাই এবছর প্রায় ১২ মণ বড় রুই মাছ ছেড়েছি।”