সাক্ষী জজ মিয়াকে নিয়ে প্রশ্ন

২১ অগাস্ট মামলার এক সময়ের আসামি জজ মিয়াকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণে আপত্তি জানিয়ে তার জবানবন্দি বাতিলের দাবি জানিয়েছে আসামি পক্ষ।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2014, 12:55 PM
Updated : 13 Oct 2014, 02:40 PM

মঙ্গলবার নাজিম উদ্দিন রোডে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বহুল আলোচিত জজ মিয়া জবানবন্দি দেওয়ার পর এই আবেদন জানানো হয়।

বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আবেদনটি গ্রহণ করে আগামী ১৩, ১৪ ও ১৫ অক্টোবর মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেছেন।

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১০৪তম সাক্ষী জজ মিয়াকে জেরার পাশাপাশি তার বৈধতা নিয়ে করা ওই আবেদনের ওপরও আদেশ তখন দেবেন তিনি।

জজ মিয়াকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণে আপত্তি জানিয়ে আসামি উজ্জ্বল ওরফে রতনের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী আবেদনে বলেন, “জজ মিয়া এই মামলার আগের অভিযোগপত্রে আসামি ছিলেন, তিনি ১৬৪ ধারায় বিচারকের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।

“তাই সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, তার জবানবন্দি এক্সপাঞ্জ করা হোক।”

২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে সেই হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পরের বছর ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বিরকোট গ্রাম থেকে জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ আদায়ের পর জজ মিয়াকে আসামি করেই চাঞ্চল্যকর এ মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

কিন্তু পরে অধিকতর তদন্তে দেখা যায়, ওই মামলাকে ‘ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য’ বিগত চারদলীয় জোট সরকারের নির্দেশে সিআইডি জজ মিয়াকে নিয়ে নাটক সাজানোর চেষ্টা করে। তখনকার তদন্ত কর্মকর্তারা এখন আলোচিত এই মামলার আসামি। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালে জজ মিয়াকে আসামি থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে আদালত তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিলে ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।

এরপর অধিকতর তদন্তে সর্বমোট ৫২ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ। তখন জজ মিয়া ও তার মা-বোনকে সাক্ষী করা হয়।

জজ মিয়ার আগে সম্প্রতি এই মামলায় সাক্ষ্য দেন তার মা জোবেদা খাতুন ও খোরশেদা আক্তার। তারা দুজনই বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে জজ মিয়াকে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।

‘ওপরের নির্দেশ’

আদালতে জবানবন্দিতে জজ মিয়া প্রায় এক দশক আগে তাকে গ্রেপ্তার, সিআইডি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতনের বর্ণনা দেন। দীর্ঘ জবানবন্দি দেওয়ার সময় তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।

জজ মিয়া বলেন, তার ইউনিয়নের চৌকিদার মোখেলেসের মাধ্যমে  ২০০৫ সালে প্রথমে তাকে সেনবাগ থানায় ধরে নেওয়া হয়েছিল। চোরাচালানের মামলা রয়েছে জানিয়ে তাকে থানায় নেওয়ার পর নোয়াখালীর পুলিশ সুপার তার সঙ্গে কথা বলেন। মারধরের পর চোখ বেঁধে তাকে ঢাকায় আনা হয়।

“এসপি থানায় বলেছিলেন, তুই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলি। যদি এটা স্বীকার না করিস, তাহলে অন্য মামলায় আসামি করে তোকে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেব।”

ঢাকায় সিআইডি কার্যালয়ে আনার পরও একই হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করেন জজ মিয়া।

“ঢাকার আমার সঙ্গে কয়েকজন কথা বলেন। তারা বলেন, আমরা যেভাবে বলি তোকে সেভাবে শুনতে হবে। আমাদের কথা শুনলে তুই বেঁচে যাবি। তখন আমি বলি, স্যার, তাহলে কিভাবে বাঁচাবেন? তারা বলে, তোকে রাজসাক্ষী রাখা হয়েছে, তোর ফ্যামিলি আমরা দেখব।”

জজ মিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, সিআইডি কর্মকর্তা রুহুল আমিন তখন তাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের কিছু করার নেই, এটা উপরের নির্দেশ’।

জবানবন্দিতে জোবেদা বলেছিলেন, জজ মিয়ার মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ‘পুরস্কার’ হিসেবে তাকে প্রতি মাসে মাসে ২ হাজার টাকা করে দিতেন সিআইডির দুই কর্মকর্তা রুহুল আমিন ও আব্দুর রশিদ।

বোনের সঙ্গে আদালত প্রাঙ্গণে জজ মিয়া (গত ৮ সেপ্টেম্বরের ছবি)

জজ মিয়া সাক্ষ্যে বলেন, সিআইডি কার্যালয়ে থাকার সময় সেনবাগের ওসির সরেঙ্গ তিনি কথা বলতে পারতেন। পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণের খরচ দেওয়ার কথাও তাকে বলা হত।

স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হওয়ার পর শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার অনেকগুলো ভিডিও দেখানো হয়েছিল জজ মিয়াকে।

“তারা (সিআইডি কর্মকর্তা) বলেন, আমরা যা শেখাব, আদালতে তাই বলবি। এরপর মামলার শুনানির তারিখ চলে আসে। এর মধ্যে একদিন পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মুন্সী আতিক আমাকে বলেন, যা তোমাকে বলা হয়েছে, তা ঠিক আছে তো। এরপর তিনি আমাকে দিয়ে অনেকের নাম বলান।”

ওপরের চাপের কথা সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা মুন্সী আতিকুর রহমানও বলেছিলেন বলে দাবি করেন জজ মিয়া।

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলায় খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন মন্ত্রী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদকেও অধিকতর তদন্তে মামলার আসামি করা হয়।

জজ মিয়া বলেন, “সিআইডি অফিসে আমাকে রেখে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে অনেক ঘটনা মুখস্ত করানো হয। এরপর আমাকে কোর্টে নেওয়া হয়। কোর্টে নেওয়ার আগেও তিনি (মুন্সী আতিক) আমাকে বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?”

আদালত থেকে কারাগারে পাঠানোর পর মুন্সী আতিক ও রুহুল আমিন দুজনেই দেখা করতে যেতেন বলে দাবি করেন জজ মিয়া।  

“তারা আমাকে বলেন, আমাদের ভুলে যেও না, আর কিছু লাগলে আমাদের বলিও।”

জোট সরকার আমলে মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান, সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুর রশীদ এই মামলায় জামিনে রয়েছেন।

জামিনে থাকা আসামিরা হলেন, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং ঢাকার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম।

মুজাহিদ, বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৫ জন রয়েছেন কারাগারে।

তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জেল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জন আসামি পলাতক রয়েছেন।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন।

শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই খালেদা জিয়ার শাসনামলে ওই হামলা চালানো হয়েছিল বলে পরে তদন্তে উঠে আসে।