মায়ের দুধে অনীহা: কাজ করে সামাজিক বাধাও

ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর জন্য শুধু মায়ের দুধই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ খাদ্য হিসাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হলেও বাংলাদেশে শিশুকে বিকল্প খাদ্য দেওয়ার পেছনে সামাজিক বাধাও অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে।

কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2014, 10:07 AM
Updated : 19 Sept 2014, 10:21 AM

বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, রক্ষণশীল মনোভাবের কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। আর সে কারণেই স্বাস্থ্যকর্মীরা সহজে মায়েদের পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেন না।

কম বয়সে বিয়ে হওয়াকেও বিকল্প শিশুখাদ্য দেওয়ার পেছনে একটি কারণ হিসাবেই দেখেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনিস্টিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চের জেন্ডার অ্যান্ড এসআরএইচআর  (সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস) বিশেষজ্ঞ শুচি করিম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দেশে এখনো বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৩-১৪ বছর বয়সে। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই তারা প্রথম সন্তানের মা হয়। বিয়ে বা গর্ভধারণ কোনোটাই সেই বয়সে মেয়েটির সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘটে না।

“একটা ১৪-১৫ বছরের মেয়ে যখন মা হয়,তখন শারীরিকভাবেই সে এতো বেশি অসুস্থ বা দুর্বল থাকে যে নিজের ব্যাপারেই সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, অথবা নেয়ার মতো অবস্থায় থাকে না। সেখানে সন্তানকে কখন কী খাওয়ানো হচ্ছে, সেই সিদ্ধান্ত সে নিবে তা তো চিন্তাই করা যায় না।”

এ কারণেই বেশিরভাগ সদ্যজাত শিশু মায়ের বুকের প্রথম দুধ, যেটা শালদুধ বা কলোস্ট্রাম নামে পরিচিত, তা থেকে বঞ্চিত হয় বলে মনে করছেন তিনি।

“কিন্তু যে কোনো শিশুর জন্য এই শালদুধই সবচেয়ে বেশি জরুরি। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি বিষয়,” বলেন তিনি।

মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে বেসরকারি সংস্থা টিচিং অ্যাসিসটেন্স ফর হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন (তান) ফাউন্ডেশন। রাজধানীর উত্তর বাড্ডা ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও সেবা দিয়ে থাকে এ সংগঠনটি।

তান ফাউন্ডেশনের ফিল্ড ম্যানেজার রত্না গোমেজ বলেন,“আমাদের প্রকল্পের আওতাধীন এলাকায় প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে আমরা খোঁজ নিই কোন কোন বাড়িতে গর্ভবতী মা রয়েছেন। অনেক সময় দেখা যায় যেসব বাড়িতে বয়স্ক সদস্য রয়েছেন, তারা আমাদের বাড়িতে যাওয়া পছন্দ করেন না। অনেক সময় ঢুকতে দিতেও চান না।

“তারা বলেন, আমাদের সময়ও বাচ্চা-কাচ্চা হয়েছে, এখনও হবে, এসব স্বাস্থ্যকর্মীর দরকার নাই। আমরা তখন মায়েদের আগে তাদের বোঝাই। অনেকে একটু বোঝালেই বোঝেন, অনেককে বিভিন্নভাবে বোঝাতে হয়।তবে বোঝানোর পর সবাই কম-বেশি মেনে নেন বিষয়গুলো।”

তবে পরিবারের কর্তা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের মানসিকতাই একমাত্র বাধা না। জনসমক্ষে সন্তানকে বুকের দুধ দেয়া এখনো সামাজিকভাবে, বিশেষ করে নগর জীবনে রীতিমতো ‘ট্যাবু’ হিসেবে দেখা হয়। ফলে ঘরের ভেতরে সন্তানকে বুকের দুধ দেওয়া মায়ের জন্য সমস্যা না হলেও ঘরের বাইরে গেলেই মায়েরা কৃত্রিম পুষ্টিযুক্ত প্যাকেটজাত বিকল্প শিশুখাদ্যের উপর নির্ভর করতেই পছন্দ করেন।

ঢাকায় থাকেন ১১ মাস বয়সী জাহরার মা নাতাশা সাবরিন খান।

তিনি বলেন,“বাচ্চার জন্য মায়ের দুধ সবচেয়ে ভালো এটা সব মা-ই জানেন। কিন্তু সেরেল্যাক (কৃত্রিম পুষ্টিযুক্ত বিকল্প শিশুখাদ্যের একটি ব্র্যান্ড) জাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস বাচ্চার না থাকলে বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ অনেক মাই প্রাইভেসি ছাড়া বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।”

তবে পল্লী অঞ্চলে এ জটিলতা অনেক কম বলে মনে করেন গবেষক শুচি করিম।

তিনি বলেন, নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে এক ধরনের ‘প্রাইভেসি’র ধারণা চলে আসে। এটা গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় না।

“গ্রামে মায়েদের মধ্যে কাজ করতে করতেই সন্তানদের বুকের দুধ দেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এমনকি কৃষাণি মায়েরা মাঠে কাজ করার সময় অন্যদের সঙ্গে গল্প করার মধ্যেও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান।

“কোনো এক চরাঞ্চলে প্রকল্পের কাজে গিয়ে দেখেছিলাম, কিস্তির টাকা দিতে আসা এক মা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েই বাচ্চাকে বুকের দুধ দিচ্ছেন। ঢাকায় এমনকি আমার অফিসে এমন কিছু ঘটলে তো সবাই নিজ নিজ জায়গাতেই অজ্ঞান হয়ে যাবে,” নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।

জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধই শিশুর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ খাদ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় পুষ্টিগুণ প্রাকৃতিকভাবেই সে পেয়ে থাকে মায়ের দুধ থেকে। শিশুর শরীরে প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় মায়ের দুধের মাধ্যমেই।

এছাড়া ছয় মাসের পরে সম্পূরক খাদ্য হিসেবেও বাড়ির সাধারণ খাবার খাওয়ানোই শ্রেয় বলে মনে করেন বিশ্বের সব দেশের চিকিৎসাবিদ ও পুষ্টিবিদরা। তবে বিভিন্ন কারণে অভিভাবকদের মধ্যে বাজারে বিক্রি হওয়া বিকল্প শিশুখাদ্যের প্রতি বেশি ঝোঁক দেখা যায়।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংয়ের (ইবিএফ)হার ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ।

শিশুর সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে জন্মের পর থেকেই সে যাতে শুধু মায়ের দুধ গ্রহণ করে, তা নিশ্চিত করার বিষয়ে উদ্যোগ রয়েছে সারা বিশ্বেই। শিশুদের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে ১৯৮১ সালে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্টমিল্ক সাবস্টিটিউটস’ নামে পরিচিত।

এরপর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ প্রণয়ন করা হয়।২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর এ আইনটি সংশোধন করা হয়। তবে সংশোধিত আইনের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ১৯৮৪ সালের আইনটি রহিত করা হয়েছে এই আইনেই।

আইন সম্পর্কে না জেনেই দোকানে বিকল্প গুঁড়ো দুধ ও ফর্মুলাগুলো বিক্রি করছেন সাধারণ দোকানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুপার শপগুলো পর্যন্ত।