বুধবার রাতে পূর্ব রাজাবাজারে বাড়ির সবাইকে বেঁধে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছে।
ফারুকী ইসলামী ফ্রন্টের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। সেই সঙ্গে সুন্নিভিত্তিক সংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতেরও নেতা ছিলেন তিনি। তিনি হাই কোর্ট মাজার মসজিদের খতিবও ছিলেন।
নুরুল ইসলাম বেসরকারি চ্যানেল আইয়ের ‘শান্তির পথে’ ও ‘কাফেলা’ নামে দুটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন।
হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিহতের বাড়ির কাছে গ্রিন রোডে বিক্ষোভ করেছে ইসলামিক ফ্রন্ট ও ছাত্রসেনার নেতা-কর্মীরা। চট্টগ্রামে বিক্ষোভ থেকে কয়েকটি গাড়ি ভাংচুরও হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ২টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয়েছে বলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মহাসচিব আ ন ম মাসুদ হোসেন আল কাদরী জানিয়েছেন।
কী কারণে নুরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি। তবে তার অনুসারীরা বলছে, হিযবুত তাওহীদ, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের বিরোধিতা করতেন তিনি। এজন্য এর আগে হুমকিও পেয়েছিলেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার গোপীবাগে মুরিদ সেজে কথিত এক পীরের বাড়িতে ঢুকে ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে ইসলামী উগ্রপন্থিরা জড়িত বলে পুলিশ বলছে।
নুরুল ইসলাম ফারুকীর হত্যাকাণ্ডের ধরনও একই রকম বলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা বলছেন। তবে তার বাসায় অন্যদের বেঁধে শুধু তাকেই হত্যা করা হয়।
ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ওই বাসায় যান। দ্রুততম সময়ে খুনিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের কারণে কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে, না কি ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে, তা তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।”
নুরুল ইসলাম হজে লোক পাঠানোর কাজেও যুক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। হজের কথা বলেই কয়েকজন যুবক রাতে বাড়িতে ঢুকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে।
১৭৪ নম্বর পূর্ব রাজাবাজারে চারতলা একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় নুরুল ইসলাম ফারুকী ভাড়া থাকতেন।
রাত ১১টায় ওই বাড়িতে গিয়ে বসার ঘর ওলট-পালট অবস্থায় দেখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক গোলাম মুজতবা ধ্রুব।
নুরুল ইসলামকে হত্যা করা হয় তার শোবার ঘরে, ওই স্থানটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা।
হত্যার খবর মুনে বাড়ির সামনে ও আশপাশে ইসলামিক ফ্রন্টের কয়েকশ’ নেতা-কর্মী জড়ো হন। রাত দেড়টার দিকে লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নেয়ার সময়ও তারা হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিলেন।
ওই বাসায় থাকা নুরুল ইসলামের ভাগ্নে মারুফকে উদ্ধৃত করে রাজধানীর মিরপুরের বায়তুল রশিদ মসজিদের ইমাম মুফতি ইহসানুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “সাড়ে ৮টার দিকে হজে যাওয়ার কথা বলে বাসায় আসে দুই যুবক। দরজা খোলার পর তাদের সঙ্গে আরো ৬/৭ জন লোক ঢুকে পড়ে।
“তারা অস্ত্র বের করে বলে- কত টাকা আছে, আমাদের দেন। নুরুল ইসলাম বলেন, এখন বাসায় এক লাখের মতো টাকা আছে। তখন তারা বলে- আমরা এতগুলো মানুষ, এক লাখ টাকায় আমাদের হবে না।”
এরপর বাড়ির সবাইকে গামছা ও কাপড় দিয়ে হাত-পা বেঁধে নুরুল ইসলামকে শোবার ঘরে নিয়ে জবাই করা হয় বলে মুফতি ইহসানুল জানান। এরপর ওই যুবকরা চলে যায়।
বাসায় তখন মারুফ ছাড়া ছিলেন নুরুল ইসলামের স্ত্রী, শ্বাশুড়ি ও গৃহকর্মী। নুরুল ইসলামের তিন ছেলের মধ্যে বড়জন আহমেদ রেজা ফারুকী বর্তমানে সৌদি আরব রয়েছেন। মেজ ও ছোট ছেলে তখন ঘরে ছিলেন না।
মেজ ছেলে ফয়সাল ফারুকী ঘরে ঢুকে এই অবস্থা দেখে সবাইকে খবর দেন, খবর পেয়ে পুলিশও যায়।
শেরে-বাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক সাব্বির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাত ৯টার দিকে তারা গিয়ে শোবার ঘরে নুরুল ইসলাম ফারুকীর গলাকাটা লাশ দেখতে পান।
হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য কারা বাড়িতে ঢুকেছিল, তাদের পরিচয় জানাতে পারেননি কেউ।
তবে এদের দুই যুবক দুদিন আগেও একবার বাড়িতে এসেছিল বলে ফয়সাল ফারুকী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “খাদেমরা দুজনকে চিনেছিল। সেদিন আসার পর আব্বা তাদের আজকে আসতে বলেছিলেন। তাদের হাতে পিস্তল ও চাপাতি ছিল।”
নুরুল ইসলামের সার্বক্ষণিক সহচর (খাদেম) আহমদ নুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলায় উনাকে এর আগেও হুমকি দেয়া হয়েছিল।”
উপকমিশনার মাসুদ বলেন, “সন্দেহের তালিকায় যা সামনে আসবে। তা ধরেই এগোবে তদন্তের কাজ।”
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সাক্ষ্য নিয়েছেন বলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত তেজগাঁও অঞ্চলের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানিয়েছেন।
চট্টগ্রামে ভাংচুর
ঢাকায় নুরুল ইসলাম ফারুকীকে খুনের পর চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ করেছে ইসলামী ফ্রন্ট ও ইসলামী ছাত্রসেনার নেতাকর্মীরা।
তারা মুরাদপুর, ষোলশহর দুই নম্বর গেইট এলাকায় ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়।
রাত সোয়া ১০টার দিকে মুরাদপুরে জামেয়া আহমদীয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও ইসলামী ছাত্রসেনার কর্মীরা রাস্তায় নেমে আসে।
এক পর্যায়ে তারা মুরাদপুর মোড়ে গাড়ি ভাংচুর শুরু করে। পরে ষোলশহরেও যানবাহন ভাংচুর শুরু হয়।
এসময় গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং সাধারণ পথচারীরা প্রাণভয়ে এদিক ওদিক পালাতে থাকে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড কাঁদুনে গ্যাসও ছোড়ে।
আন্দরকিল্লা, চেরাগী পাহাড় ও প্রেসক্লাব মোড়েও রাতে খণ্ড খণ্ড মিছিল করে ছাত্রসেনার কমীরা।
নগরীর বাইরে পটিয়া, হাটহাজারী ও আনোয়ারা উপজেলায়ও প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে বলে ইসলামী ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় মহাসচিব এম এ মতিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।