প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখাবে মোদি সরকার: পঙ্কজ শরণ

.বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2014, 02:00 PM
Updated : 14 June 2014, 04:06 AM

(নির্বাচনী প্রচারণার সময়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোয়, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ‘তথাকথিত’ ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ অভিবাসীদের বিতাড়নের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে নরেন্দ্র মোদি ও তার দলীয় সহকর্মীরা, তারাই এখন দিল্লির ক্ষমতায়। ওই হুঁশিয়ারির পর ১৯৯০-এর দশকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ের মতো আবারো ‘পুশ ব্যাক’ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। অনেকের মনে এখনো জ্বলজ্বল করছে পুশ ব্যাকের সেই ইতিহাস। তবে ক্ষমতায় আসার পর তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি এগিয়ে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ইতিবাচক আভাসই দিয়েছেন মোদি। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ সরণ মনে করেন, দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো হেরফের হবে না। ভারতে ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নানা বিষয় নিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, যা একাত্তর টেলিভিশনে শুক্রবার প্রচারিত হয়।)

খালিদী: পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের দিন-তারিখ কি চূড়ান্ত?

সরণ: সত্যি বলতে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের সফরগুলো এখনো আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে। আমরা সফরের দিন-তারিখ চূড়ান্ত করার বিষয়ে কাজ করছি। খুঁটিনাটি বিষয়গুলো চূড়ান্ত হওয়ার পরই আমরা এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারব।

খালিদী: তারপরও কোনো সম্ভাব্য তারিখ?

সরণ: এখনো হয়নি। দিন-তারিখ চূড়ান্তের বিষয়টি এখনো আলোচনার মধ্যে আছে। (সফরের) বিষয়টি চূড়ান্ত হলে এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হলেই কেবল আমরা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারবো।

খালিদী: আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদিকে প্রথম বিদেশ সফরে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যদিও তিনি প্রথম সফরে ভুটান যাচ্ছেন এবং আমি যদি ভুল না করি, সম্ভবত তার পরবর্তী সফর হবে টোকিওতে। কিন্তু তিনি (মোদি) তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। আমরা বিষয়টিকে কিভাবে দেখতে পারি?

সরণ:
এ ব্যাপারে আমার প্রথম কথা হচ্ছে, দু’দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে যে যোগাযোগ হচ্ছে সে ব্যাপারে এখনই কথা বলাটা ঠিক হবে না। কিন্তু এটা ঠিক যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। এ আমন্ত্রণে তিনি খুব সম্মানিত বোধ করেছেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়া, এর গতিপথ নির্ধারণ, আলোচনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ এবং অগ্রাধিকার- এসবই আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি তাই সত্যিকার সম্পর্কের দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে চাই।    

খালিদী: তাহলে কি এটা ধরে নেয়া যে, বাংলাদেশকে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো নিয়েই এগিয়ে যেতে চাইলেও তিস্তার পানি বণ্টনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে এগোনোর মতো অবস্থানে নেই মোদি সরকার? এ চুক্তি স্বাক্ষরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেই কি তিনি ঢাকা আসবেন?

সরণ: আমার মনে হয় প্রশ্নটির মধ্যে অনেক যদির কথা আছে। আমি বলতে চাই, ভারতের এই নতুন সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরুর দিনেই মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের স্পিকারের বৈঠকের মধ্যে দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। বৈঠকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলপ্রসূ ছিল। কারণ এর মধ্যে দিয়ে দুই দেশের নেতৃত্ব পর্যায়ে আলোচনায় বসার পথ সুগম হয়েছে। তারা সব বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন এবং সেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে নতুন সরকারের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে। ওই আলোচনায় ভারতের নতুন সরকার সম্পর্ককে শুধু এগিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতিই দেয়নি, বিগত বছরগুলোর মতো একে আরো জোরদার করার বিষয়েও আগ্রহ দেখিয়েছে।   

খালিদী: সবশেষ বিজেপি ক্ষমতায় থাকার দিল্লি বলেছিল, বাংলাদেশে ক্ষমতায় কারা থাকবে সে ব্যাপারে তাদের কোনো পছন্দ নেই। সে সময় ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র ঢাকায় এসে বাংলাদেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে দিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়, ভারত শুধু আওয়ামী লীগই নয়, বাংলাদেশের যে কোনো সরকারের সঙ্গেই কাজ করতে আগ্রহী। এবারও বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নেতাদের উচ্ছ্বসিত হতে দেখা গেছে। ‘বাংলাদেশে আপনাদের পছন্দের কোনো দল নেই’- আপনারা কি পুরনো সেই নীতিতেই ফিরে যাবেন?

সরণ: আমি বিষয়টি এতো জটিলভাবে দেখতে চাই না। আমি বলতে চাই, ভারতের কোনো সরকারই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার নীতি অনুসরণ করে না। বাংলাদেশে কারা নেতৃত্ব দেবে, কোন দল নির্বাচিত হবে- তা একান্তই দেশের জনগণের বিষয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশে যত সরকার এসেছে, সবার সঙ্গেই এই নীতি অনুসরণ করেছে ভারত। আমি মনে করি, এতেই ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়। দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের সময়ই কোনো না কোনো বিষয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। আবার এটাও ঠিক, কোনো কোনো সময় দুই দেশের সম্পর্কে খুব একটা গতি আসেনি। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে, গত ৪০ বছরে দুই দেশের প্রায় সব বিষয়েই সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। আজকে আমাদের সম্পর্ক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে সম্পূর্ণ সম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে। অতীতের চেয়ে আমাদের সম্পর্ক এখন অনেক বেশি গভীর এবং বেশি সহযোগিতাপূর্ণ, এটা আমি দাবি করতেই পারি।

খালিদী:
এবার ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে চোখ ফেরানো যাক। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ওই নির্বাচনকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে নতুন নির্বাচনের পক্ষে কথা কথা বলছে। তবে ভারত ওই নির্বাচনকে ‘সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তা’ বলে আখ্যা দিয়েছে। নতুন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও কি একই রকম থাকবে?  

সরণ:  আমার মনে হয়, সেসময় আমাদের বক্তব্য ছিল- সাংবিধানিক প্রয়োজনেই নির্বাচন হয়েছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে- এমনটাই আশা করা হয়েছিল। আমি মনে করি, আমাদের এখন বর্তমানকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। পুরনো বিষয় নতুন করে সামনে আনার কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না, এখনকার এজেন্ডাই ভিন্ন।

খালিদী: তাহলে ভারত অগণতান্ত্রিক পথে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল সমর্থন করে না?

সরণ: এখানের সমর্থনের কিছু নেই। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণই মূল এবং একমাত্র বিষয়। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করাটা ভারতের জন্য ধৃষ্টতার সামিল।

খালিদী: আপনি জানেন- বাংলাদেশে অনির্বাচিত, সামরিক এবং অগণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতা নেয়ার ইতিহাস রয়েছে। আপনি কি মনে করেন, এ ধারা বন্ধ করতে ভারতের কোনো ভূমিকার প্রয়োজন আছে? 

সরণ: আপনি দেখবেন, ১৯৪৭ সাল থেকে আমরা এক ধরনের নীতি অনুসরণ করে আসছি। আমরা ভারতের মধ্যে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে খুবই সতর্ক। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে আমরা নানা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছি। ভারতের সীমারেখার বাইরের কোনো বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আবার ভিন্ন রকম হয় এবং এতে অনেক বিষয় জড়িত থাকে।

খালিদী: পশ্চিমা বিশ্ব কিন্তু এমনটা খুব কমই করে...

সরণ: আমার মনে হয়...

খালিদী: ভারতও এখন বড় শক্তি...

সরণ: প্রতিটা দেশের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি বলতে চাই, সব দেশেরই অন্য কোনো দেশের ব্যাপারে আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। ভারতের ক্ষেত্রে আমরা এমন অবস্থায় আছি যে রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এমন অবস্থায় আমরা অন্য কোনো দেশে গণতন্ত্রকে সহায়তা করি না। আমার মনে হয়, এর কোনো প্রয়োজন নেই.....   

খালিদী: সহযোগিতা না করলেও গণতন্ত্র রক্ষার বিষয়টি তো আসে?

সরণ:
আমরা বার বার বলেছি, কোনো দেশের সরকার কিভাবে চলবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার শুধু ওই দেশের জনগণেরই রয়েছে। অন্য কোনো দেশ, সেটা প্রতিবেশী হোক কিংবা আরো দূরের কোনো দেশ, যখনই কেউ আমাদের কাছে সহায়তা চেয়েছে, আমরা অন্য কোনো উপায়ে তা দিয়েছি। উদাহরণ হিসেবে সক্ষমতা অর্জন, প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা কিংবা অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মতো সহযোগিতার কথা বলা যায়। এসবের মধ্যে দিয়েই আমরা বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে সহায়তা দিয়েছি। স্বাভাবিক চর্চার অংশ হিসেবেই আমরা কারিগরি সহায়তা, অভিজ্ঞতার বিনিময়, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা দিয়ে থাকি। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা বিশ্বের যে কোনো দেশের পক্ষ থেকেই ভারতের কাছে নির্বাচন আয়োজন অথবা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার সহযোগিতা চাওয়া হোক না কেন, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ে খুবই আগ্রহী।      

খালিদী: পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্নে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতের আগ্রহের অনেক বিষয়ে, বিশেষ করে নিরাপত্তার বিষয়ে কাজ করছে। আপনি স্বীকার করবেন, বিশেষ করে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান একটি নিয়মিত বিষয়। আমি নিশ্চিত, সম্প্রতি হবিগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের পর আপনিও এবিষয়ে একমত হবেন। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র, মর্টার ও রকেট লঞ্চারের মতো ভারী অস্ত্র ভারতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আপনি কি উদ্বিগ্ন নন?

সরণ: অবশ্যই এটি উদ্বেগের বিষয়। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যতম মূল বিষয় হচ্ছে আমাদের দীর্ঘ সীমান্ত। সত্যি বলতে, বাংলাদেশের সঙ্গেই আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসিতপূর্ণ সীমান্ত এলাকাও এটি। একইসঙ্গে দরিদ্র সীমান্তও বটে....

খালিদী: অনেক ফাঁকফোকরও...

সরণ: নিম্ন আয়, অনুন্নয়ন এবং নানা ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণেই সীমান্ত এলাকায় এসব ফাঁকফোকরের সৃষ্টি হয়েছে, এখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র। এজন্যই ভারত ও বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি গভীরভাবে সম্পর্কিত। তাই সীমান্ত এলাকাকে সব ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডমুক্ত করতে দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ কিংবা ভারত- কেউই একা এই কাজ করতে পারবে না। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মধ্যে সমঝোতা হলেই কেবল এক্ষেত্রে সফলতা আসতে পারে। কারণ দুই দেশেই অশান্তি এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মতো লোক রয়েছে। আমি মনে করি এদেরকে সহায়তা দিয়ে কোনো দেশই লাভবান হতে পারবে না।  

খালিদী: তাহলে আপনি স্বীকার করছেন, দুই দেশের জন্য একই ধরনের হুমকি রয়েছে। কিন্তু এসব অস্ত্রের (হবিগঞ্জে উদ্ধার হওয়া) বেশিরভাগই চীনে তৈরি।

সরণ: অস্ত্রগুলো কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। বিষয়টি আমি তদন্তকারী সংস্থাগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছি, আমি মনে করি এটা তাদেরই কাজ। আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

খালিদী:
আপনি আগে বলেছিলেন, সরকার পাল্টালেও স্বার্থের পরিবর্তন হয় না। দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদল হলেও ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের হেরফের হবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের কোন কোন স্বার্থগুলো কখনোই পরিবর্তন হবে না বলে আপনি মনে করেন?

সরণ: আমি আমার সেই বক্তব্য স্পষ্ট করতে চাই। আমি বলতে চেয়েছি, সাধারণ বিবেচনায় দুই দেশের স্বার্থ একই থাকে এবং তা রক্ষায় সম্পর্কের মূল নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন হয় না। কিন্তু আমি আগে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম তার সঙ্গে আজকের সময়ের অনেক পার্থক্য আছে। সবচেয়ে বড় তফাত হলো আমাদের এখন নতুন একটি সরকার আছে। ফলে যে প্রশ্নগুলো উঠেছিল, সেগুলোর উত্তর দেয়াটাও জরুরি।  

খালিদী: তাহলে আগের ওই বক্তব্য নিয়ে আপনি একটু চিন্তিত?

সরণ: না, ওটা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমি যা বলতে চাই তা হলো- নতুন সরকারের অগ্রাধিকার ঠিক করে প্রেসিডেন্ট লোকসভায় একটা বক্তব্য দিয়েছেন। আর নতুন সরকারের প্রণীত সুস্পষ্ট অগ্রাধিকারগুলোর ভিত্তিতে সংহত ও আন্তঃসম্পর্কিত দক্ষিণ এশিয়া প্রাধান্য পাবে- এমন একটি দক্ষিণ এশিয়া যা হবে সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল। এ ধরনের সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর মধ্যেই আমরা একটি নীতিমালার রূপরেখা উপস্থাপন করেছি। কিন্তু এর পরও বাংলাদেশের আরো স্বার্থ আছে। তাই আমি বলতে চাই, নতুন সরকারের কাজ দেখেই আমরা বিচার করব।

খালিদী: চীন ঢাকায় নতুন সরকারকে সমর্থন দিয়েছে এবং দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কও দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চীন সফর করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারত যে পরস্পর আরো ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তা কি ভারতকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে?

সরণ: অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ কীভাবে সম্পর্ক রাখবে তা নিয়ে মন্তব্য করা খুবই ধৃষ্টতাপূর্ণ হবে বলে আমি মনে করি। আমার সীমা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যন্তই। এদেশের পররাষ্ট্র নীতি কীভাবে চলবে তা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না। ওটা বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের বিষয়। যেহেতু চীনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করেছেন, তাই আমি বলব, চীন, ভারত, বাংলাদেশ, জাপান- আমরা সবাই এশিয়া মহাদেশের অংশ। আমার মনে হয়, আমরা সবাই এখন খুব স্পষ্টভাবেই একমত যে এশিয়ায় একটি আঞ্চলিক সহযোগিতার রূপরেখা প্রণয়নের দিকে আমাদের এগুতে হবে, যার মধ্যে এশিয়ার জন্গণের জন্য ব্যাপক গুরুত্বের বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। ধরুন, চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গত ১০/১২ বছর ধরে উল্লেখযোগ্যভাবে আবর্তিত হয়েছে। গতবছর ২০১৩ সালে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৬৬ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আমি যদি ভুল না করে থাকি, তাহলে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারতে চীনা চুক্তির পরিমাণ ছিল ৫৮ হাজার কোটি ডলার। তাই দেখা যাচ্ছে এখানে নতুন মাত্রা তৈরি হয়েছে, একটি নতুন বাস্তবতা জায়গা করে নিচ্ছে। ওই বাস্তবতা হলো- এশিয়া উপমহাদেশ নিজের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক বিনিময় করছে এবং সবগুলো দেশের তুলনামূলক সুবিধার জন্যও কাজ করছে। তাই আমি মনে করি, এই পথেই আমাদের এগুতে হবে এবং এটা সব দেশের জন্যই ভাল হবে।

খালিদী: জনাব হাইকমিশনার, চীনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। চীন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা, যা কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এটা আপনার কাছে কেমন মনে হয়? এটা নিয়ে ভারতের নিরাপত্তা কৌশল বিশেষজ্ঞরা কি হৈ চৈ করবে না। নাকি আপনি মনে করেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশের ক্ষেত্রে সোনাদিয়া ভারতের জন্যও কাজে দেবে?

সরণ: আমার মনে হয়, আপনার প্রশ্নের দুটো দিক আছে। এক. গভীর সমুদ্র বন্দর হিসেবে সোনাদিয়া এবং দুই. বন্দর নির্মাণের কাজে সুনির্দিষ্ট দেশের অংশগ্রহণ। প্রথমে আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসি।  আপনি যদি বাংলাদেশের ভেতরে, সোনাদিয়ার মতো জায়গায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের বিষয়ে মত জানতে চান তাহলে আমি বলব, বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের সহায়তায় এবং তা এগিয়ে নিতে যেকোনো ধরনের অবকাঠামোর উন্নয়নকে ভারত সমর্থন করবে এবং স্বাগত জানাবে। বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে আঞ্চলিক সমৃদ্ধি হলে এবিষয়েও আমাদের একই অবস্থান। দেখুন, বিশ্ব পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে এবং আমরা স্বীকার করি, উদ্বৃত্ত পুঁজির বিনিয়োগ তার ঘাটতি যেখানে আছে বা চাহিদা আছে সেখানে প্রবাহিত হবে। তাই, আপনাদের ক্ষেত্রে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, চীন বিশাল পুঁজি ও বিনিয়োগ নিয়ে বসে আছে এবং এখানে পারস্পরিক স্বার্থের ব্যাপার আছে। আমরা আগেও এশীয় ও বিশ্ব পর্যায়ে বিভিন্ন ফোরামে, যেমন জি-২০-এর মতো বহুপাক্ষিক ফোরাম যেখানে আমরা চীনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করি- সেখানে বলেছি যে, আমাদের এমন একটি উন্নয়নশীল সহযোগিতামূলক রূপরেখার দিকে এগুতে হবে যা হবে এশিয়ার জন্য অনন্য এবং তা প্রত্যেকটি দেশের শক্তি বৃদ্ধি করবে। কারণ, চূড়ান্ত অর্থে এশিয়া মহাদেশের প্রত্যেকটি দেশ ও প্রতিটি সদস্যের জন্য কার্যকরভাবে আরো সুষম ও সর্বাত্মক উন্নয়ন হোক তা আমরা চাই।

হ্যাঁ, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সরকার বলেছে, জাতীয় স্বার্থের উপর ভিত্তি করেই আমাদের বিদেশ নীতি পরিচালিত হবে। তাই, উপরোক্ত অবস্থানের ভিত্তিতে আমরা যদি লক্ষ্যের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব দেখি, যা আমাদের নিরাপত্তা ও জাতীয় কৌশলগত বিষয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করে তাহলে সীমা অতিক্রম করতেই হবে। এর বাইরে সাধারণ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে অবকাঠামোর উন্নয়ন, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে- তাকে অবশ্যই স্বাগত জানাবে ভারত।

খালিদী: আরো সুনির্দিষ্ট দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে ফিরে আসি। ভারতীয় চিন্তাবিদদের পরামর্শ আমলে নিয়ে ভারত কি সব অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে সর্বাত্মক চুক্তি সই করার বিষয়ে রাজি হবে?

সরণ:
হ্যাঁ, আমি জানি এবিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। পানি সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ চলছে। ১৯৭২ সালেই যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠিত হয়েছিল।

খালিদী: তবে, এটা খুব ভালভাবে হয়নি।

সরণ: গত কয়েক বছর ধরে এটার নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে না।

খালিদী: এটার কারণ কি?

সরণ: আমার মনে হয়, এটা যে ঘটেছে তার অনেকগুলো কারণ আছে। আসলে জেআরসির রূপরেখার বাইরেও অনেক আলোচনা হচ্ছে। তাই মনে করা হয়েছিল যে, অন্য ফোরামেই যদি কাজ হয়ে যায় তাহলে তাতেই আলোচনা চলুক। কিন্তু যৌথ নদী কমিশনের গত বৈঠকে ছয়টি নদীকে চিহ্নিত করে সেগুলোর পানি বণ্টনের বিষয়ে কাজ শুরু করতে আমরা একমত হয়েছি। তিস্তা ও ফেনী নদীর পর এগুলোও যুক্ত হলো। তাই, আমি দেখতে পাচ্ছি, ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে বিষয়টি নিয়ে আমাদের দুদেশের মধ্যে আলোচনা হবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে... দেখতে হবে দুদেশের সরকার সামনে এগিয়ে যেতে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়।

খালিদী: কিন্তু জেআরসির মতো এধরনের প্রতিষ্ঠান বা সম্মত রূপরেখা যদি এড়িয়ে চলেন তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ব্যবস্থার ওপর থেকে মানুষের আস্থা চলে যেতে পারে।

সরণ: না, যৌথ নদী কমিশন থাকবে। এটা তৈরি হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি হিসেবে। আমি এক মুহূর্তের জন্য এটাকে পাশ কাটানোর পক্ষে বলছি না। আমি শুধু আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলছিলাম যে কেন এটার বৈঠক হয়নি। এটার বৈঠক না হওয়ার কারণ হচ্ছে আমরা এই রূপরেখার বাইরেও কিছু বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নিতে পেরেছিলাম।

খালিদী: আপনি কি একমত যে এটাকে আরো কার্যকর করার দরকার ছিল?

সরণ: অবশ্যই, অবশ্যই। জেআরসি যে সংবিধির ভিত্তিতে করা তৈরি হয়েছিল তাতে নজর দিলে আপনি দেখবেন এটা ছিল চূড়ান্তরূপে সর্বাত্মক চরিত্রের। এটাতে যে শুধু পানি বণ্টনের নীতিমালা ছিল তা-ই নয় এতে আরো ছিল বন্যা সতর্কীকরণ, যৌথ গবেষণা, যৌথ ব্যবস্থাপনার বিধান এবং এটা ছিল অনেক বেশি সর্বাত্মক। তাই এটা মূলত... খুবই সীমাহীন, এটার সামনে কোনো বাধা নেই। এতে প্রয়োজনে জরুরি সভা আহ্বানেরও বিধান রয়েছে। তাই এটা খুবই সুগঠিত একটা বিধিমালা। অদূর ভবিষ্যতে আমরা এই ফোরামকে আলোচনার টেবিলে বসাতে পারব। বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে আলোচনা করতে পারব।

খালিদী: জনাব হাইকমিশনার, আরেকটি দ্বিপাক্ষিক বিষয়, প্রধান দ্বিপাক্ষিক বিষয়- স্থল সীমানা চুক্তি। আপনি কিভাবে এই বিষয়ে নিশ্চয়তা দেবেন?

সরণ: সোজা কথায় আমরা এর বাস্তবায়ন ও অনুসমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনি জানেন, সংবিধান সংশোধনের বর্তমান বিলটি সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ঝুলে আছে। সংসদে ঐকমত্য তৈরির মাধ্যমে এই বিল পাশ করতে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নতুন সরকার এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্তও করেছে, নতুন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় স্পিকারকে তা জানিয়েছেন। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আমরা কিভাবে সামনে এগুতে পারি তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করব।

খালিদী: এবার আসাম বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনো সমস্যা করবে না?

সরণ: আমি শুধু বলতে চাই আমরা একটা ঐকমত্য তৈরি করছি। নির্বাচনের পর দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সরকার এটা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

খালিদী: নতুন সরকারের কারো সমর্থনের প্রয়োজন নেই। তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে।

সরণ: হ্যাঁ, বাস্তবে লোকসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, তবে রাজ্যসভায় নেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- তারা দায়িত্ব নেয়ার শুরুতেই আপনাদের সরকারকে নিশ্চয়তা দিয়েছে। সুনির্দিষ্ট করে বললে- ২৬ মে তারা স্থল সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং অবশ্যই তার আগে অনুসমর্থন দেয়া হবে।

খালিদী: আমি আবারো সীমান্তের বিষয়ে- হত্যাসহ এধরনের বিষয়ে ফিরব। তার আগে আমাকে ভিসার বিষয়ে বলুন। মানুষ ভারতের ভিসার পদ্ধতি নিয়ে অভিযোগ করেই যাচ্ছে। ভারতের ভিসা পাওয়া কিছুটা কঠিন। কেন?

সরণ: আমি খুবই দুঃখিত যে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে আমরা এখনো সক্ষম হইনি। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কীভাবে আমাদের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা যায় তা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছি।

খালিদী:
সর্বোপরি, এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিরা, তারা ভারতে থাকতে যায় না। তারা সেখানে যায় এবং অর্থ খরচ করে। তারা পর্যটক হিসেবে বা স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে যায়। তারা ভারতে অর্থ ব্যয় করছে, ভারতের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

সরণ: না...

খালিদী: এ দেশের মানুষ ভারতের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। তারপরও আপনারা তা করতে দিচ্ছেন না। কেন?

সরণ: না, এটা ওই প্রশ্নের উত্তর নয়। ভিসা সেবা উন্নত করতে আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কার্যত যেটা ঘটছে তা হলো- সক্ষমতার সমস্য। আমাদের কাছে যে ধরনের অনুরোধ আসছে তার পূরণে আমরা এখনো সক্ষম নই।

খালিদী: আচ্ছা, বেশ। আমি আরেকটা প্রশ্ন করি আপনাকে। সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভারতে পড়তে গিয়ে এক তরুণ শিক্ষার্থীকে প্রতিবার সেখানে পৌঁছে থানায় যেতে হয়েছে। কেন?

সরণ: আমার মনে হয় না এটা সত্য নয়। তা যদি হয়ে থাকে আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।

খালিদী: জ্বি, আমি ঘটনাটা জানি। ১৯ থেকে ২০ বছর বয়সী এক তরুণীকে প্রতিবার ভারতে পৌঁছে স্থানীয় পুলিশের কাছে নাম লেখাতে হয়েছে।

সরণ: আমি বিষয়টি দেখব। কিন্তু বিধি অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময় ভারতে থাকলে পুলিশকে জানাতে হয় না, বাংলাদেশিদের এটা করতে হয় না।

খালিদী: বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের এটা করতে বলা হচ্ছে।

সরণ: আমাকে একটু খোঁজ নিতে হবে কেন এটা ঘটছে।

খালিদী: অভিযোগ আছে, এমনকি বাংলাদেশিরা বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বা মার্কিন নাগরিকদেরকেও হয়রানি করা হচ্ছে। কেন?

সরণ: আচ্ছা, ঘটনা এরকম হলে আমরা সানন্দেই বিষয়টি খতিয়ে দেখব। তবে আমি যেটা বলতে চাই, অভিবাসনের ক্ষেত্রে আমরা কিছু সংস্কার করেছি যা  ভারতগামী বাংলাদেশিদের  জন্য ইতিবাচক হিসেবে কাজ করছে। এবং আপনি জানেন যে, আমরা যৌথভাবে সহজীকরণের প্রধান যে কাজটা করেছি তাতে অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য আর ভিসার দরকার হয় না। এভাবে ব্যাপকসংখ্যক কূটনৈতিক পাসপোর্ট ভিসার বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় পাচ্ছে।

খালিদী: এই যে সার্ক অঞ্চলের ভিসা ছাড় হয়েছে....

সরণ: সার্ক ভিসার বিষয়টি আমরা দেখি না। এটা সার্ক সচিবালয়, কাঠমান্ডু থেকে হয়।

খালিদী: এটা ছিল এক বছরের জন্য, কিন্তু এখন কিছু ক্ষেত্রে তিন মাস। কেন?

সরণ: এটা সার্কের সিদ্ধান্ত।

খালিদী: আচ্ছা।

সরণ: বিষয়টি সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বা সার্কের অন্য ফোরামে আলোচনার বিষয়। কিন্তু ভারতীয় ভিসার ব্যাপারটা আলাদা। আমি বলতে পারি, অনেক ভারতীয় ভিসাতেই এখন বহুবার প্রবেশের সুযোগ থাকে।

খালিদী: অন্য একটি বিষয় যা নিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকায় বড় শিরোনাম হয় তা হলো- বাণিজ্য। এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ভারতের দিকে বেশি। ২০১২-১৩৪ অর্থবছরে দুদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫৩৪ কোটি ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ছিল ৫৬ কোটি ডলার। সেখানে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। বাংলাদেশি পণ্য নির্মাতাদের জন্য কোনো আশা আছে কি?

সরণ: অবশ্যই.... আমি মনে করি বাণিজ্যকে টেকসই করার বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তা আছে। তার মানে, ভারসাম্যহীন বাণিজ্য চিরকাল চলতে পারে না। একারণেই আমরা বাংলাদেশি পণ্যের জন্য ভারতের বাজার খুলে দিয়েছি।

খালিদী: কিন্তু ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে আপনারা সম্পূরক শুল্ক ও অন্যান্য নানা অশুল্ক বাধা আরোপ করে রেখেছেন। আপনারা বিএসটিআইয়ের প্রত্যয়নপত্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না।

সরণ:
না যেটা আমরা করছি, তা হলো জাতীয় ব্যবস্থাপনা। ভারত ও বাংলাদেশ- উভয় দেশের উৎপাদকরা এই ব্যবস্থাপনার সম্মুখীন হচ্ছে। অনুরোধ যদি এরকম হয় যে, বাংলাদেশকে আলাদাভাবে দেখা, তাহলে তা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু আমরা ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যে বড় ধরনের উল্লম্ফনের ব্যবস্থা করেছি।

খালিদী: তাতে কি খুব একটা লাভ হবে? আপনারা বলছেন বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত, আবার সেগুলোর উপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ করছেন।

সরণ: সব বাংলাদেশি পণ্য নয়। যেমন আমি আগেই বলেছি দুদেশেরই কিছু পণ্যের ওপরই শুল্ক ধরা হয়েছে, যা দুদেশের জন্যেই সমান। আমরা বাংলাদেশি পণ্যের ওপর থেকে কোটা ও শুল্ক তুলে দিয়েছি, বিশেষ করে টেক্সটাইল পণ্যের উপর থেকে যা বাংলাদেশের জন্য খুবই স্পর্শকাতর। আমাদের দেশের উৎপাদকদের বিরোধিতার মুখেও আমরা এটা করেছি। আপনি যদি ৫৬ কোটি ডলারের বাংলাদেশের রপ্তানির দিকে তাকান তাহলে দেখবেন এর মধ্যে বেশির ভাগটাই তৈরি পোশাক খাতের  পণ্য। এটার ভিত্তি খুব ছোট হলেও সম্ভাবনা অনেক। আমি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানাব- আপনারা ব্যবসার  রূপরেখা বদলে ১২০ কোটি মানুষের বাজার ধরার চেষ্টা করুন।

খালিদী: স্থল বন্দরের অবকাঠামোগুলো ভাল অবস্থায় নেই। এর জন্য ভারত কি করতে পারে বলে আপনি মনে করেন।

সরণ: আমি আপনার সঙ্গে একমত। বাণিজ্যের বাধা প্রসঙ্গে আমি বলব স্থল বন্দরের অবকাঠামো অবশ্যই একটা বড় বাধা। এবং এক্ষেত্রে আমি দুদেশের সরকারকেই দায়ী করব। আমি সানন্দে জানাতে চাই, নতুন সরকার স্থল বন্দরের বিষয়ে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে। সমস্যা হলো এসব অবকাঠামো ৪০, ৫০ ও ৬০ এর দশকের। এর কারণ হলো, আমরা ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দিতে পারিনি। আর এখন আমাদেরকে সীমান্ত অবকাঠামোর উন্নয়নে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে এবং আমরা উন্নত হচ্ছি। আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর গতবছর উদ্বোধন করা হয়েছে। পেট্রাপোল-বেনাপোল শিগগিরই উদ্বোধন হবে, যা দিয়ে বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়। এছাড়াও আমরা আরো কয়েকটি স্থলবন্দর চিহ্নিত করেছি যেগুলোকে সমন্বিত চেকপোস্ট বসিয়ে উন্নত করা হবে।

খালিদী: সবশেষ প্রশ্ন মি. সরণ। অনেক ভারতীয় নেতা ও কূটনীতিক বারবার যেমন বলেছেন, যেমন সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রির স্বামী কূটনীতিক রাজীভ সিক্রি বলেছেন, বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু। ভারত যদি বাংলাদেশকে বন্ধু হিসেবে মনে করে তাহলে আপনারা কেন সীমান্তজুড়ে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরতে চান? কেন দিল্লি সীমান্তকে সুযোগ হিসেবে না দেখে সমস্যা হিসেবে দেখছে?  বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর জন্য আপনি তো দরজা খোলাই রাখেন, তাই না?

সরণ: আমার মনে হয়, সীমানা কাঁটাতারে ঘেরার বিষয়টি বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক অনেক বছর আগে আলোচনা হয়েছিল। এখনতো বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষই আমাদের বলেছে যে কাঁটাতারের বেড়া অনেকভাবে সীমান্ত রক্ষায় সহযোগিতা করছে। এর মাধ্যমে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর টহল আরো উন্নত হয়েছে ও অপরাধমূলক বেআইনি কর্মকাণ্ড কমেছে। এর মানে অবশ্যই এটা নয় যে, বৈধ মানুষের চলাচল বা মালামাল স্থানান্তর বাধাগ্রস্ত হবে। প্রকৃতপক্ষে এটার অর্থ হলো- আমরা চেষ্টা করছি পুরো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককেই একটা আইনি রূপরেখার মধ্যে রাখার চেষ্টা করছি। কারণ দুদিকের সীমান্তেই কিছু অসৎ লোক পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে, যার পুরো নিয়ন্ত্রণ কোনো দেশের হাতেই নেই।   

খালিদী: কিন্তু পুরো সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া থাকলে এটা নিশ্চয় খুব ভাল লাগবে না।

সরণ: আমি বলব, আমাদের আসলে গুরুত্ব দিতে হবে কিভাবে বৈধভাবে মানুষ, বিশেষ করে পর্যটকরা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহজে চলাচল করতে পারে। আমার মনে হয়, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি জানেন, ভারতের ভিসা আমরা বিনা পয়সায় দিই, এজন্য কোনো ফি দিতে হয় না।

খালিদী: বাংলাদেশি ভিসাও?

সরণ: বাংলাদেশি ভিসাও, এটা একটা ভাল সিদ্ধান্ত। এটা উভয়ের জন্যই ভাল সিদ্ধান্ত এ কারণে যে আমাদের দুই পক্ষেরই উপলব্ধি হয়েছে যে অভিবাসনের ক্ষেত্রে অবৈধ সব পদ্ধতি থেকে আমাদের বৈধ পদ্ধতিতে উপনীত হতে হবে।

খালিদী: হাইকমিশনার, সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।  

সরণ: আপনাকেও ধন্যবাদ।