মোবারকের যুদ্ধাপরাধের রায় যে কোনো দিন

যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘রাজাকার কমান্ডার’ মোবারক হোসেনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে ট্রাইব্যুনাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 June 2014, 05:59 AM
Updated : 2 June 2014, 03:36 PM

তার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, অপহরণ ও লুটতরাজের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

সোমবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ উভয়পক্ষের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে মামলার বিচারিক কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।

এ মামলাটির কার‌্যক্রম শেষ হওয়ার ফলে এখন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত দুই ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে।মামলাগুলো হলো- জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী,অপর নেতা মীর কাসেম আলী এবং পলাতক বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন।

এছাড়া আপিল বিভাগে রায়ের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে আরেকটি মামলা।

সোমবার প্রসিকিউশনের করা দুটি আবেদন মঞ্জুর করে ট্রাইব্যুনাল মামলাটির কার‌্যক্রম শেষ ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল।এর মধ্যে একটি আবেদন ছিল মোবারকের বিরুদ্ধে আনা একটি অভিযোগে ঘটনার সময় সংশোধনের আবেদন। অপর আবেদনটি তথ্যপ্রমাণ হিসেবে অতিরিক্ত কিছু নথি অন্তর্ভূক্ত করার জন্য।

মোবারকের বিরুদ্ধে মানবতাবরোধী অপরাধের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে দাবি করে তার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে প্রসিকিউশন।

এর আগে গত ২১ মে মোবারকের পক্ষে আইনী পয়েন্টে যুক্তি উপস্থাপন করেন আইনজীবী তাজুল ইসলাম। এর আগে মামলার মূল বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন মোবারকের আরেক আইনজীবী মিজানুল ইসলাম।

মোবারকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান ও সৈয়দ হায়দার আলী যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন।

প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী তার আইনী যুক্তিতে বলেন, একাত্তর সালে মোবারক হোসেন ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় হিন্দুদের মন্দির দখল করে মূর্তি ভাংচুর করে চরম পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। এটি একটি পরিকল্পিত অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

অন্যদিকে আসামিপক্ষ দাবি করে, আসামি মোবারক হোসেন নির্দোষ। ‘পচাঁ-গলা,বাসি, দূর্গন্ধযুক্ত বিষয়কে প্লাস্টার করে’ প্রসিকিউশন মামলা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। মোবারকের মামলা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

এ মামলায় তিনি খালাস পাবেন বলে আশা প্রকাশ করে আসামিপক্ষ।

২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, আটক, নির‌্যাতন ও লুটপাটের পাঁচটি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৬ মে সূচনা বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়।

মোবারকের বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া থানার টানমান্দাইল ও জাঙ্গাইল গ্রামে ৩৩ জনকে হত্যা, আনন্দময়ী কালীবাড়ী রাজাকার ক্যাম্পে আশুরঞ্জন দেবকে নির্যাতন, ছাতিয়ান গ্রামের আব্দুল খালেককে হত্যা, শ্যামপুর গ্রামের দু’জনকে অপহরণ করে একজনকে হত্যা এবং খরমপুর গ্রামের একজনকে আটক  রেখে নির্যাতন।

এসব অপরাধ ১৯৭১ সালের আগস্ট  থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

২০১৩ সালের ২০ মে মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।প্রসিকিউশনের মোট ১২ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছে।

এরা হলেন- মামলার মুক্তিযোদ্ধা দারুল ইসলাম,শহীদ আব্দুল খালেকের মেয়ে খোদেজা বেগম ও ছেলে রফিকুল ইসলাম,মো.খাদেম হোসেন খান,আলী আকবর, মো.আব্দুল মালেক,মুক্তিযোদ্ধা ননী গোপাল মল্লিক,আব্দুস সামাদ,শহীদজায়া ভানু বিবি,আব্দুল হামিদ,ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের সুপারিনটেনডেন্ট চমন সিকান্দার জুলকারনাইন এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্যামল চৌধুরী।

গত ২৫ নভেম্বর প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ এবং তাদের আসামিপক্ষের জেরা শেষ হয়।

২৬ নভেম্বর মোবারক হোসেনের মামলায় তিনজন সাফাই সাক্ষী নির্ধারণ করে গত বছর ২৬ নভেম্বর অনুমতি দেয় ট্রাইব্যুনাল।

গত ১৮ এপ্রিল মোবারকের পক্ষে তৃতীয় ও শেষ সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য তারিখ ধার্য ছিল। তবে তার আইনজীবী তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে জানান,তারা সাক্ষী হাজির করতে পারেননি।

ফাইল ছবি

এরপর সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করে ১১ মে থেকে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেয়া হয়। পরে তা পিছিয়ে ১৮ মে কারিখ ধার‌্য করে ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন আসামি মোবারক হোসেন নিজে ও তার বড় ছেলে মোহাম্মদ আসাদ উদ্দিন। উভয় সাক্ষীকেই সাক্ষ্য দেয়া শেষ হলে জেরা করে প্রসিকিউশন।

প্রসিকিউশনের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আখাউড়ার নয়াদিল গ্রামের মোবারক একাত্তরে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের তৈরি রাজাকারের তালিকায়ও তার নাম রয়েছে।

একাত্তর পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করলেও পরে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন এবং এক পর্যায়ে আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। দুই বছর আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

একাত্তরে একটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ২০০৯ সালের ৩ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মোবারকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।

তখন হাই কোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন তিনি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এরপর তার মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

গত বছর ১৫ জুলাই মোবারক হোসেনকে দুই মাসের জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর কয়েক দফায় তার জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ১২ মার্চ অভিযোগ আমলে নিয়ে জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি মোবারকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। ১২ মার্চ অভিযোগ আমলে নিয়ে জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে গত ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে তদন্ত চালায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।