১০ বছরে ২ হাজার র‌্যাব সদস্যের শাস্তি

সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরুর পর নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় গত ১০ বছরে ২ হাজার র‌্যাব সদস্যের শাস্তি  হয়েছে, যার বড় অংশই সামরিক বাহিনী থেকে আসা কর্মকর্তা।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2014, 05:51 PM
Updated : 10 May 2014, 06:00 PM

নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে হত্যায়ও র‌্যাবের যে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তারা তিনজনই সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা।

সেনাবাহিনীর দুজন এবং নৌবাহিনীর যে তিনজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তাদের ইতোমধ্যে অবসরে পাঠানো হয়েছে।  র‌্যাব তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও চালাচ্ছে।

র‌্যাবের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে গঠনের পর থেকে বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত  র‌্যাব সদস্যের সংখ্যা ১ হাজার ৯৪৯ জন।

অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে ১৬ জনেরও বেশি র‌্যাব সদস্য দণ্ডনীয় অপরাধ করেছেন।

নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় সামরিক বাহিনী (সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী) থেকে র‌্যাবে আসা সদস্যদের পরই বেশি শাস্তি হয়েছে পুলিশ সদস্যদের।

বর্তমান র‌্যাবের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। এই বাহিনীতে ৪৪ ভাগ পুলিশ, ৪৪ ভাগ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং বাকি ১২ ভাগ বিজিবি, আনসার, কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য বিভাগের।

র‌্যাবের তথ্য বলছে, এই বাহিনীতে থাকাকালীন বিভিন্ন অপরাধে চলতি বছরের ৬ মে পর্যন্ত  গুরু এবং লঘু দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে আসা ৭২৯ জন, নৌবাহিনীর ৫৪ জন এবং বিমান বাহিনীর ৬২ জন রয়েছেন।

এছাড়া পুলিশের ৮১৭ জন, বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) ২০৬ জন এবং আনসারের ৮১ সদস্য র‌্যাবে দায়িত্ব পালনকালে নানা অভিযোগে সাজা পেয়েছেন।

বাহিনী গঠনের ৫ মাসের মাথায় ২০০৪ সালের ২৩ অগাস্ট গাবতলী হাটে গরু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা ছিনতাই করে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হন কয়েকজন র‌্যাব সদস্য। সেটিই ছিল জনসম্মুখে প্রকাশ হওয়া র‌্যাব সদস্যদের সংগঠিত প্রথম অপরাধ।

ওই ঘটনায় তিনজন র‌্যাব সদস্য জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

শুরুতে জঙ্গি দমনসহ এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাস দমনে নানা মহলে ‘প্রশংসিত’ হলেও ‘ক্রসফায়ার’ ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে মানবাধিকার সংগঠনগুলো র‌্যাবের সমালোচনায় মুখর।

র‌্যাবের মুখপাত্র হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “র‌্যাব একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় তা তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। কাউকে ছাড় দেয়া হয় না।”

নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় অভিযোগ ওঠার পর র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান সংসদীয় কমিটিকে বলেছেন, কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা তারা করবেন না।  

র‌্যাব সূত্র জানায়, কর্তব্যে অবহেলা, চাঁদাবাজি, নিরীহ ব্যক্তিকে আটকে রেখেনির্যাতন, মূল্যবান জিনিস ও টাকা আত্মসাৎ এবং মারামারির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সাজাপ্রাপ্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে।

এছাড়া মামুলি চুরি, কর্মকর্তার অস্ত্র হারিয়ে ফেলা, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মারধর করা, গোপন তথ্য ফাঁস করা, মদপানসহ ছোটখাটো নানা অপরাধেও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে।

র‌্যাব জানিয়েছে, সাজাপ্রাপ্তদের কারো কারো বিরুদ্ধে মামলা, কাউকে চাকরিচ্যুত করা, বেতন কেটে নেয়া, র‌্যাব থেকে মূল বাহিনীতে ফেরত পাঠানো অথবা কাউকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, এই পদমর্যাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগের অভিযোগটি উঠেছিল চট্টগ্রামের র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক জুলফিকার আলী মজুমদারের বিরুদ্ধে।

২০১১ সালের ৪ নভেম্বর চট্টগ্রামে তালসারা দরবার শরিফের প্রায় ২ কোটি টাকা লুটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকারকে চাকরি হারাতে হয়। গ্রেপ্তারও করা হয় তাকে।

২০০৯ সালে জুলাই মাসে এক ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক করে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ আসে র‌্যাবে বদলি হওয়া সহকারী পুলিশ সুপার মো. সোয়েব আহমেদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে র‌্যাব থেকে সরিয়ে দিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।

র‌্যাবের দায়িত্ব পালনকালে মেজর আবু মোহাম্মদ সিদ্দিক আলম ২০১০ সালের জুলাই মাসে চাকরি হারিয়েছেন অবৈধভাবে এক ব্যবসায়িকে আটক রেখে মারধরের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়।

নারী কেলেঙ্কারিতেও জড়িত হয়ে আলী আহমেদ, রফিকুল ইসলাম এবং আবুল কালামসহ কয়েজন র‌্যাব সদস্য শাস্তি পেয়েছেন। ফেনসিডিল বিক্রিতে জড়িত থাকায় চাকরি যায় এক র‌্যাব সদস্যের।

অস্ত্র বহনে আপত্তি জানানোয় পুলিশের থেকে র‌্যাবে আসা সামসুল আলম নামে এক উপ পরিদর্শককে সংস্থাটি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। র‌্যাবের গোপন তথ্য বাইরে প্রকাশ করায় পুলিশের এক সহকারী উপ-পরিদর্শককে পদাবনতি করে কনস্টেবল করা হয়।

ভিওআইপি অভিযানের সময় ক্যামেরাসহ কিছু জিনিসপত্র আত্মসাতের অভিযোগে মোছেমুল ইসলাম নামে এক র‌্যাব সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে।

র‌্যাব সূত্র জানায়, ১ হাজার ৯৪৯ জন সাজাপ্রাপ্তের মধ্যে জেল, জরিমানা বা বরখাস্তের মত গুরুদণ্ড পেয়েছেন ৬৭৯ র‌্যাব সদস্য। এদের মধ্যে জেলসহ বরখাস্ত হয়েছেন ১২ জন, শুধু বরখাস্ত হয়েছেন ১০৭জন।

তিরস্কারের মতো লঘুদণ্ড পেয়েছেন ১ হাজার ২৭০ র‌্যাব সদস্য। শৃঙ্খলা ভঙ্গে র‌্যাব থেকে মূল বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৪১০ সদস্যকে।

পদাবনতি ও জরিমানার মতো দণ্ড পেয়েছেন ৫৫৫ জন। এছাড়া চাকরি থেকে বরখাস্ত আরো পাঁচজনের আদালতে বিচার চলছে।

র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কিছু কিছু ঘটনার তদন্ত এখনো চলছে। তার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাটি যোগ হল।