এবার মীর কাসেমের রায়

উভয়পক্ষের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষ হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেম আলীর যুদ্ধাপরাধের মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছে ট্রাইব্যুনাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 May 2014, 06:22 AM
Updated : 5 May 2014, 06:15 PM

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রোববার মামলার কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করে এই আদেশ দেয়।

জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের এই সদস্যের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে হত্যা, লাশ গুম, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

রোববার আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন মীর কাসেম আলীর আইনজীবী তানভীর আহমেদ আল আমীন। এরপর আসামিপক্ষের জবাবে পাল্টা ও সমাপনী যুক্তি উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ।

উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হলে বেলা ১২টার দিকে ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।

এসময় চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন,“আমরা উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনলাম। সাথে সাথেই তো রায় দেয়া যায় না। রায় লিখতে হবে, অনেক কিছু পর্যালোচনা করতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী মামলার রায় অপেক্ষমান রাখলাম।”

প্রসিকিউশন মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে দাবি করে আইনি যুক্তিতর্কে আসামি পক্ষের আইনজীবী তানভির আহমেদ আল আমীন আসামির খালাস চান।

প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানরা খান খান করে দিয়েছিল এ দেশটিকে। সেখানে জন্ম নেয় আরেক বাঙালি খানের নির্মম ইতিহাস।

“১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলীর নির্যাতনের প্রমাণ উঠে এসেছে।সেই ‘বাঙালি খান’ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। আমরা তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাই।”

গত ২৯, ৩০ এপ্রিল ও ৪ মে রোববার মীর কাসেম আলীর পক্ষে তিন কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমীন।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১২ অভিযোগের বিষয়ে ঘটনাভিত্তিক এবং আইনি পয়েন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তারা। প্রথম ও পঞ্চম অভিযোগে প্রসিকিউশনের সাক্ষী না থাকায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেনি আসামিপক্ষ। 

এর আগে গত ২৭ ও ২৮ এপ্রিল মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমন।

তারা মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১২টি অভিযোগের বিষয়ে ও আইনি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। প্রথম ও পঞ্চম নম্বর অভিযোগে সাক্ষী না থাকায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেননি প্রসিকিউশন।

গত ২১ ও ২২ এপ্রিল মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাক্ষ্য দেন তিনজন সাফাই সাক্ষী। তারা হচ্ছেন- মীর কাসেম আলীর ছোট বোন মমতাজ নুরুদ্দিন, চট্টগ্রামের কোতয়ালী থানাধীন স্টেশন রোডের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্দা মোহাম্মদ আলী এবং চট্টগ্রামের উত্তর হালিশহরের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের খান।

সাক্ষ্য দেয়ার পরে তাদেরকে জেরা করেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম।

অন্যদিকে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে এবছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলামসহ মোট ২৪ জন সাক্ষী।

এরা হলেন- সৈয়দ মো. এমরান, মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, সুনীল কান্তি বর্ধন দুলাল, শহীদপুত্র শিবু দাস, মৃদুল কুমার দে, প্রদীপ তালুকদার, মুক্তিযোদ্ধা এস্কান্দার আলম চৌধুরী, মো. সালাহউদ্দিন ছুট্টু মিয়া, মো. জাকারিয়া, নাজিমুদ্দিন, মো. হাসান (১), মো. হাসান (২), ফয়েজ আহমেদ সিদ্দিকী, জুলেখা খান, মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরী, হাসিনা খাতুন, এসএম জামাল উদ্দিন, এস এম সরওয়ার ঊদ্দিন এবং লুৎফর রহমান ফারুক। জব্দ তালিকার সাক্ষী হলেন চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরির বুক সর্টার কাউসার শেখ, বাংলা একাডেমির সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া এবং বাংলা একাডেমীর প্রধান গ্রন্থাগারিক মোবারক মিয়া।

সাক্ষ্য দেয়া শেষে এদের সবাইকে জেরা করে আসামিপক্ষ।

গতবছরের ৫ সেপ্টেম্বর হত্যা,নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ১৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-১।এর আগে ২১ আগস্ট অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়।

এর আগে ১৬ মে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমসহ প্রসিকিউশন ১৪টি অভিযোগে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। ২৬ মে এ অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করার আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল-১।

১৮ নভেম্বর মীর কাসেমের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমন।

গত বছরের ২ মে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেন তদন্ত সংস্থা।

এ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে মীর কাসেমকে ২০১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ও ১২ নভেম্বর দু’দফা সেফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত সংস্থা।

২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ওইদিন বিকেলে মতিঝিলে দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের কার্যালয় থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে বিকেল সোয়া চারটার দিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেম আলীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে ওইদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এরপর ১৯ জুন মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মীর কাসেমের জামিন আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, কাসেম আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ওই সময় চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম শহর শাখারও সভাপতি ছিলেন।
 
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক পদেরও দায়িত্ব পান।
 
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনেতিক দলগুলোর সহযোগিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের সমন্বয়ে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়।

সেই আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী স্বাধীনতাবিরোধী মূল ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
 
মামলায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম শহরের দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিং (চামড়ার গুদাম), সালমা মঞ্জিল, ডালিম হোটেলসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে মীর কাসেম আলী তার সহযোগীদের নিয়ে আলবদর বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এসব নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে বহু মানুষকে ধরে নিয়ে তিনি দিনের পর দিন নির্যাতন এবং অনেক লোককে হত্যা করেন।
 
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’ ১৯৭৩ এর ৩ (২) (এ) (জি)/৪ (২) ধারায় মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে চট্টগ্রামের আসাদনগর ও পাঁচলাইশ এলাকায় আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও লাশ গুম এবং ৩৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন ঘটনার অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ ছাড়া বাকি সব ক’টি অভিযোগেই অপহরণ এবং নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে।

১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করলে মীর কাসেম তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন।

মীর কাসেম আলী জামায়াতের অন্যতম প্রধান অর্থ জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত। তিনি রাবেতা আলম আল-ইসলামী নামে একটি এনজিও’র সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি। এই প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন তিনি জামায়াতে ইসলামীর কর্মী হিসেবে যোগ দেন।

১৯৮০ সালের পরে  জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য হন তিনি। ১৯৮৫ সাল থেকে দলটির শূরা সদস্য হিসেবে নিয়োজিত হন।

জামায়াতসমর্থক বলে পরিচিত দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানও তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানেরই সংবাদপত্র দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন।

মীর কাসেম ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক।