নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযানে গাড়ি জব্দ, আটক ১২

কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি গাড়ি জব্দ এবং ১২ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2014, 02:28 PM
Updated : 4 May 2014, 09:34 AM

ছয় দিন আগে অপহরণের পর নূর হোসেনের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি।

অপহৃত সাতজনের লাশ পাওয়ার ‍দুদিন পর শনিবার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার শিমরাইলে নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালানো হল।

অভিযানে নূর হোসেনকে পাওয়া যায়নি। তবে তিনি দেশেই রয়েছেন বলে ধারণা নারায়ণগঞ্জের নতুন পুলিশ সুপার খন্দকার মুহিদ উদ্দিনের।

তবে এই অভিযানকে লোক দেখানো অভিহিত করে নজরুলপত্নী সেলিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অপহরণের পরপরই অভিযান চালানো হলে তার স্বামীকে হয়ত জীবিত পাওয়া যেত।

গত ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নজরুল এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে।

পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামীর পর একই স্থান থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে সাতজনকে অপহরণ দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে।

তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে নজরুল ও চন্দনসহ অন্যদের লাশ ভেসে উঠলে ক্ষুব্ধ জনতা শিমরাইলে নূর হোসেনের কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়।

বৃহস্পতিবার পুড়িয়ে দেয়া হয় নূর হোসেনের কার্যালয়

নূর হোসেন ও নজরুল দুজনই আওয়ামী লীগে যুক্ত। নজরুল ছিলেন ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, নূর হোসেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের।

সিটি কর্পোরেশন হওয়ার আগে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দুজনের রেশারেশি ছিল বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।

নজরুল থাকতেন সিদ্ধিরগঞ্জের পশ্চিম মিজমিজি এলাকায়, এক সময়ের পরিবহণ শ্রমিক নূর হোসেনের আবাস তার কাছেই কাচপুর সংলগ্ন শিমরাইলে।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেনের বাড়ি ঘেরাও করে শনিবার সকাল ১১টার দিকে পুলিশ অভিযান শুরু করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।   

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমানের নেতৃত্বে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে অভিযান চালিয়ে বেরিয়ে আসার পর দুপুরে জেলা পুলিশের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ।

এতে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপরাধ) গোলাম ফারুক এবং জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মুহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

এই অপহরণকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে সৈয়দ নূরুল ইসলামকে বদলি করার পর নারায়ণগঞ্জের দায়িত্বে আসা মুহিদ উদ্দিন বলেন, “আমাদের কাছে তথ্য ছিল, কিছু লোকজন নূর হোসেনের বাড়িতে গোপন বৈঠক করছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়।

অভিযানে সন্দেহজনক একটি মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়েছে,যা সিআইডি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে বলে জানান তিনি।

ওই বাড়ি থেকে ১২ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার। এর মধ্যে নূর হোসেন নেই বলে নিশ্চিত করলেও আটকদের পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি তিনি।

অভিযোগ জানানোর এতদিন পর অভিযান নিয়ে নজরুলের স্ত্রীর ক্ষোভের বিষয়ে মুহিদ উদ্দিন বলেন, “গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান চালাই। এত দিন আমাদের কাছে খবর ছিল না।”

সেলিনা ইসলামের মামলার বিষয়েও তদন্ত চলছে বলে জানান তিনি।

নজরুলের স্ত্রীর মামলা দ্বিতীয় আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. ইয়াসিন বিদেশে চলে গেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে।

নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান

নূর হোসেনও বিদেশে পালিয়ে গেছেন কি না- জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমরা তেমনটি মনে করি না। তিনি দেশেই আছেন।”

সেলিনার অভিযোগ, গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সিটি কর্পোরেশনের একটি রাস্তা প্রশস্তকরণ কাজকে কেন্দ্র করে নূর হোসেনের ফুফাতো ভাই মোবারকের সঙ্গে নজরুলের বিরোধ ও বাগবিতণ্ডা হয়।

ওই ঘটনার পর নূর হোসেনের আত্মীয় মোবারক বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নজরুলের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়ে বের হওয়ার পরপরই অপহৃত হন নজরুল।

এ বিষয়ে নূর হোসেনের সঙ্গে অপহরণের দিন যোগাযোগ করা হলে তিনি নজরুলের স্ত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এই ঘটনায় কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই।”

পুলিশ সুপার জানান, নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মোবাইল ফোনটি শনিবার রাতে ঢাকা থেকে উদ্ধার এবং একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ফোনটি ব্যবহার করা হচ্ছিল।

সাতজনকে তুলে নিয়ে হত্যার পর ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় থেকে ব্যবসায়ী সৈয়দ সাইফুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার রাতে অপহরণ করা হয়। শুক্রবার রাতে তাকে ঢাকার নবীনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পাওয়া যায়। 

এই অপহরণের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক নারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

সাইফুল বিকালে নারায়ণগঞ্জ হাকিম আদালতে অপহরণের বিষয়ে জবানবন্দি দেন। তবে সাংবাদিকের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি গোলাম ফারুক বলেন, “অপরাধীরা সবাই ধরা পড়বে। আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীকে স্বস্তি দিতে চাই।”

হরতালের সমর্থনে মিছিল

আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ ও হত্যার প্রতিবাদে রোববার ডাকা হরতালের সমর্থনে শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে সমাবেশ করেছে জেলা আইনজীবী সমিতি।।

আইনজীবীদের সমাবেশ

সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, জেলা সিপিবি সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন, জেলা বিএমএ সভাপতি ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান প্রমুখ।

সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে অপহরণ ও হত্যার জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিলও হয়।

আইনজীবীদের এই হরতালে বিএনপি, ন্যাপ, সিপিবি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, সন্ত্রাস নির্মুল ত্বকী মঞ্চ সমর্থন দিয়েছে।

এদিকে গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির একটি প্রতিনিধি দল দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জ জালকুড়ি বৃষ্টিধারা এলাকায় চন্দন সরকারের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারকে সান্ত্বনা জানায়।

সিটি কর্পোরেশনে কর্মবিরতির ঘোষণা

কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনের খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে রোববার থেকে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করা হবে।

তবে সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিভাগ এই কর্মসূচির আওতার বাইরে থাকবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না।

তিনি বলেন, “খুনিরা ধরা না পড়ায় আমরা ৩৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ২২ জন একত্রিত হয়ে মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করে কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”