জিয়নকাঠি হারানোর ভয় টিয়াকাঠির

মহেশখালীর টিয়াকাঠির দেলোয়ার হোসেন প্রায় ২৫ বছর ধরে লবণ চাষ করেন। বর্ষায় লবণ চাষ বন্ধ থাকলে চিংড়ি চাষ করে সংসার চলে তার।

রিয়াজুল বাশার মহেশখালী থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2014, 10:17 AM
Updated : 26 March 2014, 12:03 PM

নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে হঠাৎ করে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তিনি।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে সরকার যে সাড়ে ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছে তাতে নিজের জীবিকা হারানোর আশঙ্কায় আছেন তিনি।

দেলোয়ারের ভয়, জমি অধিগ্রহণ করা হলে লবণ চাষ বন্ধ হবে, এতে কর্মহীন হয়ে আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে তার।

সরকার অভয় দিলেও সন্দেহ কাটছে না দেলোয়ারসহ সহচাষীদের।

মহেশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) টার্মিনাল স্থাপন করে শিল্প কারখানা ও নগর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে সরকার, যাতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা দেয়া হচ্ছে।

বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের সারিতে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানের তিনগুণ বাড়িয়ে ৩৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

ওই বিদ্যুতের অর্ধেকই (১৭ হাজার মেগাওয়াট) আসবে কয়লা থেকে, যদিও বর্তমানে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ আসছে মোট উৎপাদনের তিন শতাংশের মতো।

মহেশখালীর কেন্দ্র থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের আশা করছে সরকার, যার সবটাই আসবে কয়লা থেকে।

বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে মহেশখালীতে ১০ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।”

এ লক্ষ্য সামনে রেখেই সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে মহেশখালীর ছয়টি মৌজায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রণের কাজ শুরু হয়েছে, যেসব জমিতে গ্রীষ্মকালে লবণ ও বর্ষায় চিংড়ি চাষ হয়।

শনিবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু একদল সাংবাদিক, স্থানীয় সাংসদ, বিদ্যুৎ সচিব, পিডিবির চেয়ারম্যান এবং মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে মহেশখালীর বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখেন। এ সময় স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তিনি গণসংযোগও করেন।

কক্সবাজার শহর থেকে স্পিডবোটে বকখালী নদী এবং মহেশখালীর বাঁক হয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর মাতারবাড়ি ইউনিয়ন। কুতুবদিয়া চ্যানেলের পাশে এ ইউনিয়ন সদরের বাজারে কয়েকশ মানুষ আগে থেকেই ট্রলার ঘাটে অপেক্ষা করছিলেন।

ট্রলার ঘাটে পৌঁছে প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত জনতাকে বলেন, “মহেশখালী নিয়ে আমরা মহাপরিকল্পনা করেছি। এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে, গভীর সমুদ্র বন্দর হবে, এলএনজি টার্মিনাল হবে। কলকারখানা, স্কুল, কলেজ গড়ে উঠবে, টাউনশিপ ডেভেলপ করবে, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে, এখানে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

“মাতারবাড়ি হবে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মডেল। কারো ক্ষতি হোক- তা আমরা চাই না। এ জন্যই আপনাদের দেখতে এসেছি।”

সংক্ষিপ্ত পথসভা শেষ করে বহর নিয়ে প্রতিমন্ত্রী রওনা হন টিয়াকাঠির উদ্দেশ্যে, যেখানে ১০০০ থেকে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

মাতারবাড়ি ট্রলারঘাট থেকে নদী ও বিভিন্ন খালের মধ্য দিয়ে ট্রলারে ঘণ্টাখানেক চলার পর সমুদ্রের কোল ঘেঁষা টিয়াকাঠিতে পৌঁছান বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। সেখানে দেখা যায়, শত শত বিঘা মাঠে লবণের চাষ হচ্ছে।

মহেশখালীর প্রথম কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে এই টিয়াকাঠিতেই। ইতোমধ্যে এ এলাকার দুটি মৌজা থেকে ১ হাজার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়ে গেছে।

টিয়াকাঠির বিস্তীর্ণ মাঠে নামার পর কয়েকজন লবণ চাষী প্রতিমন্ত্রীকে তাদের আশঙ্কার কথা জানান।

দেলোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার এখানকার জমি নিয়ে নিক তা আমরা চাই না। আমরাতো লবণ আর চিংড়ি চাষ ছাড়া অন্য কোনো কাজ জানি না। এই জমি সরকার নিলে আমরা বেকার হয়ে যাব।”

একই শঙ্কা বাংলাদেশ লবণচাষী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরীরও।

“প্রতি একর জমিতে লবণ চাষের জন্য একজন করে লোক লাগে। চিংড়িতেও সমপরিমাণ লোক লাগে। এছাড়া পরিবহনের কাজে কর্মী লাগে। জমি অধিগ্রহণ করা হলে এই মানুষগুলো তো কর্মহীন হয়ে পড়বে।”

মোস্তফা কামাল জানান, সারাদেশে প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হয়, এর মধ্যে মহেশখালীতেই রয়েছে ২৫ হাজার একর।

কক্সবাজারভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ লবণচাষী সংগ্রাম সমিতির সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী বলেন, “আমাদের জমি গেলে আমরা তো ভূমিহীন হয়ে যাব। তখন আমরা কি করব?”

প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা যাদের কাছ থেকে জমি নিচ্ছি, তাদের শুধু জমির মূল্যই দেব- তা নয়। তাদের ব্যবসা মূল্যায়ন করেও ক্ষতিপূরণ দেব আমরা।

“আর লবণ চাষ অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। এলএনজি টার্মিনাল ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শুরু হলে সেখানে অনেক কর্মসংস্থান হবে। যারা অনভিজ্ঞ তাদেরও কীভাবে এসব জায়গায় কাজ দেয়া যায়- তা নিয়ে আমরা ভাবছি।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে মহেশখালীতে যে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হতে যাচ্ছে, তা স্থানীয়দের বুঝতে হবে। কারণ এতে বেশি লাভবান হবে তারাই।

১২০০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার খরচ হবে জানিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, এ প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়নের কাজও এগিয়ে গেছে।

টিয়াকাঠি থেকে কালারমারছড়া, হোয়ানক, অমাবশ্যাখালী ও পানিরছড়া মৌজার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন প্রতিমন্ত্রী। সব জায়গাতেই বিস্তীর্ণ মাঠে লবণ চাষ হচ্ছে। এ চারটি মৌজা থেকে পাঁচ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করার কথা রয়েছে।

সমুদ্রের কোল ঘেঁষে এ অঞ্চলকেই কেন কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হলো- এমন প্রশ্নে বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম বলেন, “আমাদের বিদ্যুতের জন্য আমদানি করা কয়লার উপর নির্ভর করতে হবে। সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় সেখানে কয়লা নেয়া সহজ হবে। বসতিহীন প্রচুর জমিও রয়েছে সেখানে।”

নসরুল হামিদ বলেন, “এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গড়ে তোলা হলে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। আমরা ৫০ বছর এগিয়ে পরিকল্পনা করছি।”