কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের শাখায় চুরি পরিকল্পনা সাজিয়ে দুই বছর ধরে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিলেন বলে জানিয়েছেন গ্রেপ্তার সোহেল ওরফে হাবিব।
Published : 28 Jan 2014, 11:18 PM
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ঘটিয়ে ব্যাংকের ভল্ট থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা তিনি চুরি ঠিকই করেছিলেন, তবে ঘটনাটি প্রকাশের দুই দিনের মধ্যে ধরা পড়তে হয়েছে তাকে।
মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর শ্যামপুর থেকে প্রথমে সোহেলকে গ্রেপ্তারের পর তার সাবেক এক সহকর্মীকে আটক এবং চুরি হওয়া টাকার অধিকাংশই উদ্ধার করা হয় বলে র্যাব জানিয়েছে।
বিকালে গ্রেপ্তারের পর টাকার বস্তা ও গ্রেপ্তার দুজনকে উত্তরায় র্যাব সদর দপ্তরে নেয়া হয়, সেখানে গণনার পর দেখা যায়, ১৬ কোটি ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ৬৪ টাকা রয়েছে বস্তায়।
র্যাব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের পর কয়েকজন সাংবাদিকদের সামনে সোহেল এবং ইদ্রিসকে আনা হয়। তারা সাংবাদিকদের কাছে চুরির ঘটনাটি স্বীকার করেন।
সোহেল জানান, তার মামাশ্বশুর সিরাজ তাকে ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করতে উৎসাহ জোগায়, যার কাছে তিনি ৫ লাখ টাকা পান।
সোহেলের ভাষ্য, পাওনা টাকা চাইলেই ব্যাংক থেকে টাকা চুরির পরামর্শ দিয়ে সেই সঙ্গে কিভাবে চুরি করতে হয়, তা শিখিয়ে দেয় সিরাজ।
ব্যাংকের পাশে বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য সিরাজ ওই বাড়ির মালিককেও নানাভাবে প্রলুব্ধ করেছিল বলে সোহেলের দাবি।
প্রায় দুই বছর আগে অন্য এক ভাড়াটেকে সরিয়ে বাড়িওয়ালা সিরাজকে ঘর ভাড়া দেয়। আর সিরাজ সেখানে সোহেলকে থাকতে বলে ব্যাংক থেকে টাকা সরানোর পদ্ধতি বাতলে দেয়।
গত রোববার কিশোরগঞ্জ শহরের রথখোলা এলাকায় ব্যাংকের শাখায় টাকা চুরির ঘটনা ধরা পড়ে। ব্যাংকের ওই শাখার জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহসিনুল হক জানান, বিকাল ৩টার দিকে টাকার প্রয়োজনে ব্যাংকের ভল্টে ঢুকে মেঝেতে সুড়ঙ্গ দেখতে পান তিনি।
পুলিশ এসে ঘটনা তদন্ত করে ১৫ ফুট দূরে পাশের বাড়ির একটি পরিত্যক্ত কক্ষের ভেতর সুড়ঙ্গের অন্য প্রান্তের সন্ধান পায়।ওই বাড়িতেই ছিল সোহেল।
গ্রেপ্তার এই যুবক বলেন, মামাশ্বশুর সিরাজ তাকে মেঝে কাটার জন্য হাতুড়ি, শাবল মাটি সরানোর জন্য বালতি কিনে দেয়। অন্য কাউকে সঙ্গে রাখলে খবর প্রকাশ হতে পারে বলে একাই ওই ঘরে থাকতেন তিনি।
দুই বছর ধরে একাই সুরঙ্গ তৈরি করছিলেন জানিয়ে সোহেল বলেন, “প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার করে মাটি খুড়তাম এবং ঘরে রাখতাম। পরে বালতিতে করে সুযোগ মতো বাইরে ফেলে দিতাম।”
রাতে কাটলে শব্দ টের পাওয়া যাবে বলে দিনের বেলায় খুঁড়তেন জানিয়ে তিনি বলেন, সিরাজ সবসময় খোঁজ নিতেন এবং তাড়াতাড়ি করার তাগাদা দিতেন।
ওই বাড়ির অন্য একটি কক্ষে এক নারী দুই মেয়ে নিয়ে ভাড়া থাকেন, তার স্বামী থাকেন সৌদি আরবে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি কিছু টের পাননি বলে জানিয়েছেন।
“সেখানে শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে মেঝের সন্ধান পাই। এরপর একটি স্টিলের আলমারির তলা শাবলের মাথায় লাগে। এরপর পাশে খুঁড়ে ব্যাংকে (ভল্টে) ঢুকে দেখি, টেবিলের ওপর টাকার স্তূপ।”
“এত সহজে এত টাকা পাওয়া যাবে এটা কল্পনাতেই ছিল না। ধারণা ছিল ব্যাংকের ভল্ট ভাঙতে হবে।”
সোহেল জানান, তখন টাকা না নিয়ে বেরিয়ে এসে এশার নামাজ পড়ে ভাত খেয়ে রাত ১০টার পর সুড়ঙ্গ দিয়ে পুনরায় যান তিনি। সঙ্গে নিয়ে যান ১০টি বস্তা।
মোট ১০ বস্তা টাকা ঘরে এনে তা বড় পাঁচটি বস্তায় ভরে মুখ সেলাই করেন সোহেল। তবে কয়েক লাখ টাকা আলাদা করে রাখেন।
ব্যাংকে এর আগে সবচেয়ে বড় চুরির ঘটনাটিও ঘটে এভাবে। ২০০৮ সালের মার্চ মাসে ব্র্যাক ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখার ওপরের তলার ছাদ খুঁড়ে লুট করা হয় লকারে থাকা গ্রাহকদের স্বর্ণালঙ্কার।
ওই শাখাটি ছিল একটি আবাসিক হোটেলের নিচতলায়। চোররা দীর্ঘদিন ধরে ওই হোটেলের কক্ষে ভাড়া থেকে মেঝের ছাদ ফুটো করে ব্যাংকে ঢুকেছিল।
চালের বস্তায় ঢাকা এল টাকা
কিশোরগঞ্জ থেকে এই টাকা সরিয়ে ঢাকায় আনার পরিকল্পনাও সিরাজের পরামর্শ অনুযায়ী বলে দাবি করেন সোহেল।
চুরির পর দিন (শনিবার) সকালে রিকশায় করে টাকার বস্তাগুলো নিয়ে চালের দোকানে যান সোহেল। সেখানে রাস্তায় পাশে টাকাভর্তি বস্তা রেখে দুটি দোকান থেকে ২৩০ বস্তা চাল কেনেন তিনি।
এরপর ফরিদপুরের আটরশি যাওয়ার পরিকল্পনা সাজান সোহেল, যেখানে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে বার্ষিক ওরস চলছিল।
“আটরশিতে যাওয়ার জন্য একটি ট্রাক ভাড়া করতে চাইলে কোনো ট্রাকই যেতে রাজি হয়নি। অবশেষে ঢাকায় বহনের জন্য একটি ট্রাক পাওয়া যায়।”
তবে বস্তা ট্রাকে তোলার সময় ট্রাকচালকের সহকারীর সন্দেহ হলে তাকে টাকার লোভ দেখান সোহেল। ঢাকায় আসার পথে চালকের অগোচরে তার সহকারীকে ৭ লাখ টাকা দেন বলে জানান তিনি।
ট্রাকের সামনে আটরশির একটি ব্যানার লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, যাতে মানুষের সন্দেহ এড়ানো যায়। ওই ব্যানারটি সিরাজই দিয়েছিল বলে জানান সোহেল।
সন্ধ্যায় ঢাকার কদমতলীতে আসার পর চালক আর যেতে রাজি না হলে আটরশিতে যাওয়ার জন্য একটি বড় কভার্ড ভ্যান ভাড়া করেন সোহেল।
এদিকে ট্রাক থেকে চাল নামিয়ে অধিকাংশই কভার্ড ভ্যানে তোলা হয়। আট বস্তা চাল এবং টাকাভর্তি বস্তাগুলো নেয়া হয় ভাড়া বাসায়।
সোহেল বলেন, “কভার্ড ভ্যানের চালককে ভাড়া টাকা দিয়ে চালগুলো নিয়ে আটরশিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য বলে আমি বাসায় উঠি।”
র্যাবের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সোহেলের বাড়ি পটুয়াখালীতে। তার বাবার নাম সিরাজ উদ্দিন। কদমতলী এলাকায় একটি কেবল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ওই কোম্পানিতে ইদ্রিসও ছিলেন।
১৫ বছর চাকরি করার পর কিশোরগঞ্জে বিয়ে করেন সোহেল। ২০০৮ সালে তিনি শ্রমিক হিসাবে দুবাই যান। ২০১১ সালে তিনি প্রায় ৭ লাখ টাকা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
পটুয়াখালীতে নদী ভাঙনে ঘর বিলীন হয়ে গেলে কিশোরগঞ্জে থাকতে শুরু করেন সোহেল। তখনি মামাশ্বশুর সিরাজকে ৫ লাখ টাকা দেন বলে জানান তিনি।
‘১০ মিনিট দেরি’
১০ মিনিট আগে পৌঁছলে র্যাবের আগেই টাকাগুলো উদ্ধার এবং আসামি গ্রেপ্তার করতে পারতেন বলে দাবি করেছে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ।
“তবে যে সংস্থাই কাজটি করুক, কাজটি হয়েছে এটাই সান্ত্বনা,” বলেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুজ্জামান।
র্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান জানান, টাকা চুরির ঘটনার পর থেকে জেলা পুলিশের পাশাপাশি র্যাবও ছায়া তদন্ত শুরু করে। এই তদন্তকালেই র্যাব কদমতলী এলাকায় সোহেলের অবস্থান সনাক্ত করে।
চুরির ঘটনা ধরা পড়ার পর কর্তব্যরত ৮ পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। ওই শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক শেখ আমানুল্লাহ থানায় মামলা করলেও তাতে অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।
ডিআইজি নুরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, জেলা পুলিশ এর মধ্যে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। তার সঙ্গে চুরির আগে সোহেলের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়েছিল।
“বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। এর সঙ্গে আর কারা জড়িত তাদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে,” বলেন তিনি।