চিরঅন্তরালে সুচিত্রা সেন

ঊনিশশ পঞ্চাশের দশক থেকে প্রায় ২৫ বছর কোটি বাঙালির হৃদয়ে ঝড় তুলে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন পর্দার অন্তরালে; বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন এবার চলে গেলেন জীবনের জলছবি থেকেও।

মোহাম্মদ আব্দুল হালিমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2014, 04:10 AM
Updated : 17 Jan 2014, 04:10 AM

শুক্রবার সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সুচিত্রা। আর সেই সঙ্গে ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের এক সোনালী যুগের অবসান ঘটে।

১৯৭৮ থেকে ২০১৪- প্রায় তিনটি যুগ ঠিক কোন অভিমানে এ বাংলার মেয়ে সুচিত্রা নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন- শেষ পর্যন্ত তা হয়তো অজানাই থেকে যাবে তিন প্রজন্মে ছড়িয়ে থাকা অগণিত ভক্তের। এ নিয়ে জল্পনা যতোই হোক, নিজেকে আড়ালে রেখে মহানায়িকা নিজের পর্দার ছবিটিই দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী করে দিয়ে গেলেন।

‘হারানো সুর’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’  অথবা হিন্দি ছবি ‘দেবদাস’ বা ‘আঁধি’র দেখা সুচিত্রাকে তার ৮২ বছরের বার্ধক্য কখনো ছুঁতে পারবে না।

শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় গত ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কলকাতার বেসরকারি ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সুচিত্রাকে, রাখা হয় নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে।

এই ২৫টি দিন দুই বাংলার ভক্তকূল মহানায়িকার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করে গেছে। বার বার হাসপাতালে ছুটে গেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।  

শুক্রবার সকালে চিকিৎসকরা যখন ‘শেষ’ বলে দিলেন, একমাত্র মেয়ে অভিনেত্রী মুনমুন সেন,নাতনি রাইমা ও রিয়া সেন তখন হাসপাতালেই ছিলেন।

দুপুরে সুচিত্রা সেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার বালিগঞ্জের বাসায়। সেখানে সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কেওড়াতলা মহাশ্মশানে শুরু হয় মহানায়িকার শেষকৃত্য। তোপ দেগে পদ্মশ্রী পদক পাওয়া এই অভিনেত্রীকে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান।

একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেনের হাতে মুখাগ্নির পর কেওড়াতলা মহাশ্মশানে চন্দন কাঠের চিতায় শুয়ে চিরবিদায় নেন কোটি ভক্তের ভালবাসার নায়িকা। 

সুচিত্রার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানও ছিল গোপনীয়তায় ঘেরা। সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সেখানে ছিল না। কেবল নিকট আত্মীয়, টালিগঞ্জের চলচ্চিত্রজগতের কয়েকজন তারকা এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতার উপস্থিতিতেই শেষ হয় আনুষ্ঠানিকতা। দূর থেকে ছবি তুলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আলোকচিত্র সাংবাদিকদের।

অবশ্য এর আগে হাসপাতালেই মমতা জানিয়ে দেন, “সুচিত্রা সেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়েছিলেন, আমরা সেটার সম্মান করব।”

সুচিত্রা সেনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন।

প্রিয় অভিনেত্রীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের অভিনয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মীরাও।

 

পাবনার রমা থেকে কলকাতার সুচিত্রা

১৯৩১ সালের কথা। বাংলাদেশের পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে করুনাময় দাশগুপ্ত আর ইন্দিরা দাশগুপ্তের পরিবারে চোখ মেলল রমা, রমা দাশগুপ্ত।

পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় কন্যা সন্তান হলেও রমার জন্মে আপ্লুত স্কুল শিক্ষক করুনাময় পুরো এলাকার মানুষকে মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন সেদিন।

শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় পাবনার আলো-হাওয়াতেই কেটেছে রমার। শিক্ষানুরাগী পরিবারের মেয়ে রমা পাবনার মহাখালী পাঠশালার পাঠ শেষ করে পা দেন পাবনা গার্লস স্কুলে; দশম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই।

এরপর দেশভাগ আর দাঙ্গার শিকার হয়ে আরো অনেক হিন্দু পরিবারের মতো রমার পরিবারও পাড়ি জমায় কলকাতায়। সেটা ১৯৪৭ সালের কথা। ওই বছরেই কলকাতায় থিতু হওয়া ঢাকার আরেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় রমার। নামের শেষে স্বামীর উপাধি যোগ করে হয়ে তিনি হয়ে যান রমা সেন।

রমার স্বামী দিবানাথ সেন ছিলেন বিলেতফেরত শিক্ষিত যুবক। তার বাবা আদিনাথ সেন ছেলেকে সংসারী করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাই দিবানাথের সঙ্গে রমার বিয়ে হয়ে যায় একদিনের সিদ্ধান্তেই। 

দিবানাথের মামা বিমল রায় ছিলেন তখনকার খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা। ভাগ্নেবধূ রমাকে তিনিই নিয়ে আসেন রূপালী পর্দায়। রত্ন চিনতে তিনি যে ভুল করেননি, তার প্রমাণ পরের ২৫ বছর ভারতবর্ষের মানুষ পেয়েছে।

শ্বশুরের আগ্রহ আর স্বামীর উৎসাহে রূপালী জগতে নাম লেখানো রমা হয়ে যান সুচিত্রা সেন। 

 

‘শেষ কোথায়’

চলচ্চিত্রে সুচিত্রার শুরুটা হয়েছিল ১৯৫২ সালে, ‘শেষ কোথায়’ ছবির মধ্য দিয়ে, যদিও সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। পরের বছর উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতেই ‘সুপারহিট’।

১৯৫৫ সালে বিমল রায়ের পরিচালনায় হিন্দি ‘দেবদাস’ ছবিতে দীলিপ কুমারের বিপরীতে অভিনয়ের সুযোগ পান সুচিত্রা। ‘পার্বতী’ চরিত্রে তার অভিনয়ে বিমোহিত হয় দর্শক। এ ছবি তাকে এনে দেয় জাতীয় পুরস্কার।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সুচিত্রাকে। একে একে অভিনয় করেন শাপমোচন, সাগরিকা, পথে হলো দেরি, দীপ জ্বেলে যাই, সবার উপরে, সাত পাকে বাঁধা, দত্তা, গৃহদাহ, রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্তর মতো দর্শকপ্রিয় সব ছবিতে।

ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে এসে ‘আঁধি’ ছবিতে রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান সুচিত্রা।

ততোদিনে রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে সুচিত্রা সেন বাঙালি দর্শকের হৃদয়ের মনিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। কিন্তু পলিটিক্যাল-রোমান্টিক ছবি 'আঁধি'তেও সুচিত্রা ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। মূলত ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছিল বিহারের রাজনীতিক তারকেশ্বরী সিনহার জীবনী অবলম্বনে। কিন্তু সুচিত্রা সেন পর্দায় হাজির হয়েছিলেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ‘স্টাইল’ নিয়ে।

চলচ্চিত্রটির কয়েকটি দৃশ্য নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে মুক্তি দেওয়ার ২০ সপ্তাহ পরে 'নিষিদ্ধ' হয় আঁধি।

‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ১৯৬৩ সালে ‘মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে’ সেরা অভিনেত্রীর সম্মান পান সুচিত্রা। ভারতীয় কোনো অভিনেত্রীর জন্য সেটিই ছিল বড় মাপের প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার পান ১৯৭২ সালে; ২০১২ সালে পান পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পুরস্কার বঙ্গবিভূষণ।

দুই যুগের অভিনয় জীবনে বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে ৬০টির বেশি ছবিতে অভিনয় করেন সুচিত্রা।

 

উত্তম-সুচিত্রা

চলচ্চিত্রে অধিকাংশ সময়ই সুচিত্রার সহঅভিনেতা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমার। উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছাড়া সে সময় কোনো ছবি ‘হিট’ হবে, এটা ভাবা নির্মাতাদের জন্য কঠিন হতো।

এক পর্যায়ে রূপালী জগতের সফল এই জুটিকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুঞ্জন। সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করে, চলচ্চিত্রের মতো বাস্তবেও হয়তো তারা একই সম্পর্ক ধারণ করেন।

১৯৫৪ সালে এটি পোস্টার ঝড় তোলে উত্তম-সুচিত্রার সংসার জীবনে। সুচিত্রার সই দেয়া ওই পোস্টারে লেখা ছিল 'আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হলো অগ্নিপরীক্ষা'।

ভারতীয় পত্রিকাগুলোর খবর, সেই পোস্টার দেখে উত্তমকুমারের স্ত্রী গৌরিদেবী সারাদিন কেঁদেছিলেন। আর সুচিত্রাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন স্বামী দিবানাথ। অভিনয় ছেড়ে দিতেও চাপ দেন।

উত্তম-সুচিত্রা জুটির জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বি। ১৯৫৪ সালেই এ জুটির ছয়টি ছবি দারুণ জনপ্রিয় হয়। অন্তত ১০টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন দুজনে। স্বাভাবিক কারণেই অভিনয় ছাড়তে রাজি হননি সুচিত্রা।

১৯৫৭ সালে উত্তম কুমার তার প্রযোজিত 'হারানো সুর' ছবিতে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিলে সুচিত্রা বলেছিলেন, 'তোমার জন্য সব ছবির ডেট ক্যান্সেল করব।”

একদিন সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জের বাসায় এক পার্টিতে দিবানাথের আক্রমণের মুখেও পড়তে হয় উত্তমকে। এরপর থেকেই দিবানাথের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে সুচিত্রার। এক সময় শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার নিউ আলিপুরে।

 

অন্তরালে ৩৫ বছর

সংসারে টানাপড়েন শুরুর পরও অভিনয় চালিয়ে যান সুচিত্রা, তবে ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যেতে থাকেন। সব শেষ ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয় করেন। এরপর  আকস্মিকভাবেই চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে।

এরপর প্রথম তিনি আড়াল ছেড়ে বাইরে আসেন মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর। মাঝরাত পর্যন্ত বসে ছিলেন তার মরদেহের পাশে। সুচিত্রা শেষ জনসম্মুখে আসেন ১৯৮৯ সালে, তার গুরু ভরত মহারাজের মৃত্যুর পর।

২০০৫ সালে সুচিত্রাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলেও ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দিল্লি যেতে রাজি হননি তিনি।

অভিনয় জীবনের পুরোটা সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা মানুষটি ছিলেন তার নিজের এবং পরের দুটি প্রজন্মের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।  তার অন্তরালের জীবন নিয়েও কৌতূহলের অন্ত ছিল না।

কিন্তু নিজের পারিবারিক ও অন্তরালের জীবন নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা মেনে চলেছেন সুচিত্রা। শুধু তিনিই নন, তার মেয়ে চিত্রনায়িকা মুনমুন সেন, হালের নায়িকা দুই নাতনি রিয়া ও রাইমা সেনও কখনো মুখ খোলেননি।

একান্ত ব্যক্তিগত চিকিৎসক, হাসপাতালের নার্স, পত্রিকার সাংবাদিক কেউ তার অন্তরালে থাকা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি কখনো।

 

স্বেচ্ছা নির্বাসনের বেশিরভাগ সময়ই তার কাটতো রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায়।

এরপর সরকারের পরিচয়পত্র তৈরির সময় ছবি তোলার জন্য কেন্দ্রে আসেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু সে কাজটিও খুব গোপনে সেরে চলে যান তিনি।

বছর তিনেক আগে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা সুচিত্রার অন্তরালের ছবি ছাপালে বিষয়টি আদালতে গড়ায়।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেলভিউ হাসপাতালে তার কক্ষটিও ছিল কঠোর গোপনীয়তার ঘেরাটোপের মধ্যে।

তিন যুগের স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিজের চারপাশে রহস্যের যে জগৎ গড়ে তুলেছিলেন , তার ভেতরে থেকেই চিরদিনের জন্য চলে গেলেন তিনি।