বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায়ের অপেক্ষা

বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ দাস হত্যামামলার রায় হতে যাচ্ছে বুধবার বেলা ১২টায়, এক বছর আগে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যার যে ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনা উঠেছিল।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2013, 02:22 PM
Updated : 18 Dec 2013, 05:17 AM

বিরোধী দলের অবরোধের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠনের আসামিরা আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী হওয়ায় সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন বিএনপি নেতারা।

তবে হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা রেহাই পাবে না ঘোষণা দেয়ার পর আলোচিত এই মামলাটি পাঠানো হয় দ্রুত বিচার আদালতে। ওই আদালতে বছর পেরিয়ে মাস গড়ানোর আগেই বিচার কার্যক্রম শেষে রায় হতে যাচ্ছে।

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক এই মামলার রায় দেবেন, যাতে আসামির তালিকায় থাকা ২১ আসামির সবাই আদালতপাড়া সংলগ্ন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।

গত ৪ ডিসেম্বর রায়ের দিন ঠিক হওয়ার পর ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি এস এম রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “এই মামলা আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আসামিরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে বলেই আশা করছি।”

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের মধ্যে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় দরজি দোকানি বিশ্বজিৎকে।

হত্যাকাণ্ডের পর অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামি করে সূত্রাপুর থানায় মামলা দায়ের করেন ওই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জালাল আহমেদ।

হত্যাকাণ্ডের জড়িতদের ছবি ও ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর অজ্ঞাত পরিচয়দের আসামি করে মামলার সমালোচনা করেন বিরোধী দলের নেতারা।

এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী।

পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেন, “বিশ্বজিৎকে যারা হত্যা করেছে, তারা ছাত্রলীগের কর্মী নয়, তারা ছিল ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী।”

এদিকে পুলিশের তদন্ত চলতে থাকার মধ্যেই গণমাধ্যমে যাদের নাম ও ছবি আসছিল, তাদের একে একে বহিষ্কার করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।  

হত্যাকাণ্ডের তিন মাসের মধ্যে গত ৫ মার্চ ২১ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক তাজুল ইসলাম। আসামিদের মধ্যে আটজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন, বাকি ১৩ জন পলাতক।

অভিযোগপত্র গ্রহণের পর মামলা চলমান অবস্থায় বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে সরকারের সিদ্ধান্তে তা গত জুলাই মাসে পাঠানো হয় দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে।

দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে গত সেপ্টেম্বর মাসে সাক্ষ্য দিতে দাঁড়ান বিশ্বজিতের বাবা অনন্ত চন্দ্র দাস ও ভাই উত্তম কুমার দাস।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া অনন্ত দাস খুনিদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে বলেন, “আমার ছেলেকে বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে।”

মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্যে এসেছে, অবরোধের ওই দিন বাহাদুর শাহ পার্কের পাশ দিয়ে ছাত্রলীগের একটি মিছিল যাওয়ার সময় বোমা বিস্ফোরণ হলে সবাই যখন পালাচ্ছিল, তখন পলায়নরত বিশ্বজিৎকে মিছিল থেকে ধাওয়া করে তার ওপর হামলা চালানো হয়।

সাক্ষী রিকশাচালক রিপন রায় হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় বলেন, “বোমার শব্দে এক ব্যক্তি (বিশ্বজিৎ) পার্কসংলগ্ন পেট্রল পাম্পের দিকে দৌড় দেয়। ওই মিছিল থেকে ধাওয়া করে কয়েকজন ওই ব্যক্তিকে মারতে থাকে।

“ওই ব্যক্তি মার খেতে খেতে পাশের ভবনে উঠে যান। লোকগুলো সেখানেও তাকে চাপাতিসহ বিভিন্ন জিনিস দিয়ে মারতে থাকে। এরপর তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে নিচে নেমে শাঁখারীবাজারের গলির মুখে গিয়ে পড়ে যান। তখন ওই ব্যক্তি পানি চাইলে পাশের এক দোকানি পানি খাওয়ান।”

এরপর রিপনের রিকশায় মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্বজিৎকে, সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

 

ঘটনাস্থলে থাকা পরিবহনকর্মী ইউসুফ বেপারী ও আব্দুর রাজ্জাক আদালতে আসামি রফিকুল ইসলাম শাকিলকে সনাক্ত করে বলেন,  তারা তাকে চাপাতি দিয়ে বিশ্বজিৎকে কোপাতে দেখেছেন।   

এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পেছাতে বিভিন্ন উদ্যোগ ছিল আসামিপক্ষের। এ মামলার কার্যক্রম স্থগিতে ৬ আসামির আবেদন করা হলে তা খারিজ করে হাই কোর্ট।

মামলার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করায় আসামি পক্ষের আইনজীবী সৈয়দ শাহ আলমকে ১ হাজার টাকা খরচ জমা দিতে নির্দেশও দেয়া হয়েছিল।

এখনো পলাতক ১৩ আসামি

বিশ্বজিৎ হত্যামামলার আট আসামি গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তারা হলেন- রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, এ এইচ এম কিবরিয়া, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা এবং গোলাম মোস্তফা।

পলাতকরা হলেন- রাজন তালুকদার, ইউনুস আলী, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, আজিজুর রহমান, আলাউদ্দিন, ইমরান হোসেন, মীর নূরে আলম লিমন, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, কামরুল হাসান, তারিক বিন জোহর তমাল, মনিরুল হক পাভেল ও মোশাররফ হোসেন।

পলাতকদের গ্রেপ্তার না হওয়া নিয়ে বিশ্বজিতের পরিবারের উদ্বেগ থাকলেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলামের দাবি, তারা তৎপর রয়েছেন।

বিশ্বজিতের ফুপাত ভাই অপু দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে  বলেন, “অনেক দিন হয়ে গেল। হত্যা করে যদি তারা যদি পালিয়ে থাকতে পারে, তাহলে পুলিশ কী করে? পুলিশ আন্তরিক হলে আসামি পালিয়ে থাকতে পারে?”

গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাজুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৩ জন পলাতক আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আছে। পরোয়ানা প্রত্যেক আসামির থানায় পাঠানো হয়েছে। আমরা নিয়মিত খোঁজ নিয়ে থাকি। আসামিদের গ্রেপ্তারে সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছি।”

পলাতক আসামিদের কাছ থেকে কোনো ধরনের হুমকি পাচ্ছেন কি না- জানতে চাইলে বিশ্বজিতের ভাই উত্তম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেই ধরনের হুমকি তারা পাচ্ছেন না।

“যেহেতু পলাতকরা জানে যে তাদের ধরার কোনো উদ্যোগ নেই, সে কারণে তাদের ভয়ও নেই। ভয় না থাকলে তারা আমাদের হুমকি দেবে কেন?” ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।