কসাই কাদেরের বিচার পরিক্রমা

চার দশক আগে হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধের কারণে ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিতি পাওয়া যে যুদ্ধাপরাধীকে প্রথম ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হচ্ছে, তার মামলার শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর।   

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2013, 04:57 PM
Updated : 12 Dec 2013, 04:57 PM
মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ওইদিন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রোটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়।

এরপর ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। ওই মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এরইমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে। গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। 

২০১১ সালের ১ নভেম্বর প্রসিকিউশনের তদন্ত দল ট্রাইব্যুনালে যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়, তাতে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর তা আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

গতবছর ২৮ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই জামায়াত নেতার বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল-২।

দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

এর পক্ষকাল পর  ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সংশ্লিষ্টতা এবং দুটিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আদালতে প্রমাণিত হলেও  তাকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

ওই রায় প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্র-জনতার যে বিক্ষোভের সূচনা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে আন্দোলনের রূপ নিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। 

এই দাবির মুখে সরকার আন্তর্জাতিক আপরাধ আইনে সংশোধন আনতে বাধ্য হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে আইন সংশোধন করে রাষ্ট্র ও আসামি- দুই পক্ষের জন্যই আপিলের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। আগের আইনে আসামিপক্ষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার সুযোগ গেলেও রাষ্ট্রপক্ষের সে সুযোগ ছিল না।  

সংশোধিত আইনে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ৩ মার্চ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর খালাস চেয়ে পরদিন কাদের মোল্লাও আপিল আবেদন জমা দেয়।

আপিলের পর বেশ কিছু পদ্ধতিগত কাজ শেষে গত ১ এপ্রিল এই মামলার শুনানি শুরু হয়। এর আগেই আপিল বিভাগে গঠন করা হয় দুটি বেঞ্চ। একটিতে নেতৃত্বে থাকেন প্রধান বিচারপতি নিজেই, যে বেঞ্চে শুনানি হয় যুদ্ধাপরাধের আপিলের মামলা।

প্রথম দিকে ওই বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

তবে বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া অবসরে যাওয়ায় জুন মাস থেকে ৫ বিচারপতি নিয়েই শুনানি চালায় এই বেঞ্চ।

এই বেঞ্চের দুই বিচারককে যুদ্ধাপরাধ মামলা থেকে নিবৃত্ত করতে আবেদন করেছিলেন কাদের মোল্লা। শুনানির এক পর্যায়ে এই বেঞ্চের বাকি চার বিচারকও ওই আবেদন শোনেন। তবে তারা আবেদনটি গ্রহণ করেননি।

উভয়পক্ষের আইনজীবীরা ৪০ দিনের মতো এ মামলায় নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। শুনানির এক পর্যায়ে কাদের মোল্লার আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক সংশোধিত আইন এ মামলায় প্রযোজ্য হবে কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই বিচারে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তার জন্য গত ২০ জুন ৭ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতি।

সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বক্তব্যের মাধ্যমে গত ৮ জুলাই অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য শুরু হয়।

ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ২২ জুলাই অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য শেষ হয়।

শুনানি শেষে ২৩ জুলাই এই মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়। পরে রায় ঘোষণা করা ১৭ সেপ্টেম্বর।

এই রায়ে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগের মধ্যে  যে একটিতে ট্রাইব্যুনাল তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল, আপিলের রায়ে তাতে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়। অন্য চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের শাস্তিই বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

আর ছয় নম্বর অভিযোগে একাত্তরের ২৬ মার্চ মিরপুরে হযরত আলী লস্করের বাসায় গিয়ে তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা এবং এক মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশের বদলে আপিল বিভাগ সর্বোচ্চ সাজার এই আদেশ দেয়।

প্রায় আড়াই মাস পর এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। কাশিমপুর থেকে কাদের মোল্লাকে নিয়ে আসা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

দুই পৃষ্ঠার একটি ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ খামে করে এবং লাল কাপড়ে মোড়ানো ৭৯০ পৃষ্ঠার নথিসহ রায়ের কপি গত ৮ ডিসেম্বর পৌঁছে দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।  

১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু জানান, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার আগে সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। কাদের মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও নেননি।

ওইদিন রাত ১২টা ১ মিনিটেই মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হবে বলে জানায় কারা কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু আসামিপক্ষের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ রাতে এক আকস্মিক আদেশে তা স্থগিত করে দেন। ওই রাতেই কাদের মোল্লার পক্ষে পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয়। 

এরপর  ১১ ও ১২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে তা নাকচ করে দেয় প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।

১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন তার পরিবারের সদস্যরা।

বিকাল থেকেই কারাগার ঘিরে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। যাদের আন্দোলনে কাদের মোল্লার মামলা আপিল বিভাগে গিয়েছিল, সেই গণজাগরণমঞ্চের কর্মীরা আবার শাহবাগে জড়ো হয়েছিলেন দুদিন আগে থেকেই।    

বাংলাদেশের বিজয় দিবসের তিন দিন আগে ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন পর্বে পৌঁছায়।