এর মধ্য দিয়ে অপরাধযজ্ঞের দীর্ঘ ৪২ বছর পর বিচারের পর সাজা কার্যকরের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার জন্য প্রথম কারো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল।
দুদিন আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘোষণা দিয়েও আদালতের এক আদেশে তা আটকে যাওয়ার পর জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কাদের মোল্লাকে না ঝোলানোর আহ্বান জানিয়ে আসছিল।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রিভিউ আবেদন খারিজের পর আগাম কোনো ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে না এলেও কারাগারের বাইরে প্রস্তুতি দেখে ইঙ্গিত মিলছিল, ফাঁসির কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা ৬৫ বছর বয়সী এই জামায়াত নেতার সঙ্গে দেখা করে আসার পর কারাগারে মৌলভী, সিভিল সার্জন, ঢাকার জেলারের প্রবেশ এবং বাইরে নিরাপত্তা বেষ্টনি গত মঙ্গলবারের আবহ তৈরি করেছিল, যেদিন সব সব প্রস্তুতি নিয়েও দণ্ড কার্যকর শেষ পর্যন্ত হয়নি।
এরপর রাত ১০টারে কয়েক মিনিট পরই কারা অভ্যন্তরের কয়েকটি সূত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করে, ঠিক ১০টা ১ মিনিটে জল্লাদ শাহজাহানের নেতৃত্বে ছয়জন ফাঁসি কার্যক্রম শেষ করেছেন।
এই খবর প্রকাশ হলে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে, যাদের আন্দোলনের ফলে দেশজুড়ে গণজাগরণ যুদ্ধাপরাধের এই বিচারে আসামি ও প্রসিকিউশন উভয় পক্ষের আপিলের সমান সুযোগ তৈরির পথ করে দেয়। আর সেই আপিলেই আসে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়, যাকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল।
শাহবাগের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাসহ সারাদেশ থেকে উল্লাসের খবর আসতে থাকে। তাদের ভাষায়, ‘এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্মা এখন শান্তি পাবে’।
অন্যদিকে কাদের মোল্লার দল জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে খুন -ধর্ষণের দায়ে দেয়া মৃত্যুদণ্ডকে ‘হত্যাকাণ্ড’ অভিহিত করে হরতাল ডাকে রোববার বিজয় দিবসের আগের দিনটিতে।
হরতাল ডাকার পর বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি-স্থাপনায় অগ্নিসংযোগও চলে। সাতক্ষীরায় পিটিয়ে মারা হয় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে।
এর মধ্যেই রাত সোয়া ১১টার দিকে পুলিশ-বিজিবি-র্যাবের পাহারায় কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে কাদের মোল্লার লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স। কড়া পাহারায় রাতেই লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার ভাষানচর ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামে। সেখানে ভোররাতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে হত্যাকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সব বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরও চেম্বার বিচারপতির একটি আদেশে গত মঙ্গলবার ফাঁসির মঞ্চ থেকেই ফিরে আসেন একাত্তরের এই ঘাতক।
তবে বৃহস্পতিবার দিনে পুনর্বিবেচনার দুটি আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর রাতেই ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় একাত্তরের কসাই কাদেরকে।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
পরে গত ৫ ফেব্রুয়ারি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এই দণ্ড দেয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ছিলো না। সর্বোচ্চ দণ্ডের দাবিতে প্রতিবাদে জেগে উঠে ছাত্র-জনতা।
উভয়পক্ষকে আপিলে সমান সুযোগ দিয়ে সংশোধন করা হয় আইন, যে আইনে করা আপিলে গত ১৭ সেপ্টেম্বর কাদেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়।
মঙ্গলবার ফাঁসি কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ মুহুর্তে চেম্বার বিচারকের আদেশে তা আটকে যায়। বৃহস্পতিবার পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার পর রায কার্যকরে বাধা কাটে।
কাদের মোল্লার আগে ওই ট্রাইব্যুনালে বর্তমান ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সাবেক সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। তবে পলাতক থাকায় তার ওই রায় বাস্তবায়ন হয়নি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর চিকন আলী নামে এক দালালের ফাঁসি হয়েছিলো, তবে জেনারেল জিয়ার আমলে তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে যান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঘাতক দালালদের বিচারে আইন প্রণয়ন আদালত গঠন করা হলেও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই উদ্যোগ থেমে যায়।
এরপর ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে দেশে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়, যা পরে রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে পরিণত হয়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এর আহ্বায়ক।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী নেই’ মন্তব্য করে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ সমালোচনার ঝড় তোলেন।
এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের উদ্যোগে গঠিত হয় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে তাদের আন্দোলনে শরিক হয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি আওয়ামী লীগের ইশতেহারে স্থান পায়।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারে তরুণ প্রজন্ম ব্যাপক সাড়া দেয়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহুল প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়।
ওইদিন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। পরে আরো একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
এই দুই ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত মোট ৯টি রায়ে ৭জন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। একজনকে ৯০বছর কারাদণ্ড, একজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। দণ্ডিতদের মধ্যে তিনজন পলাতক রয়েছেন।