পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ, ফাঁসির বাধা কাটল

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

সুলাইমান নিলয়ও কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2013, 06:12 AM
Updated : 12 Dec 2013, 01:33 PM

আর এর মধ্য দিয়ে একাত্তরের হত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া প্রাণদণ্ড কার্যকরের আইনি বাধাও কাটল।

‘রিভিউ’ আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা ও মূল আবেদনের ওপর দুই দিন শুনানির পর প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারকের আপিল বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দেয়।

আদেশের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে রিভিউ খারিজ করে দেয়ায় রায় কার্যকরে এখন আর কোনো আইনগত বাধা নেই।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষ আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বলে তিনি আশা করছেন।

যা কিছুই ঘটুক, তা কারাবিধি অনুযায়ী হতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আপিল বিভাগের আদেশের পরপরই সরকার সমর্থক আইনজীবীদের উচ্ছ্বাস এবং জামায়াত সমর্থক আইনজীবীদের ক্ষোভ প্রকাশ করে মিছিল করতে দেখা যায়।

 

এক পক্ষ শ্লোগান দেয়- ‘ক তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’। অন্যদিকে জামায়াত সমর্থকদের মিছিল থেকে শ্লোগান দেয়া হয়- ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’। এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিও হয়।

খারিজ আদেশের পর আদালতের কাছে আদেশের অনুলিপি চান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনি রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল। আপনি বলে দিলেই হবে।”

মাহবুবে আলম বলেন,  চেম্বার আদালতের আদেশে অনুলিপি কারাগারে গিয়েছিল। এবার ‘রিভিউ’ খারিজের আদেশের অনুলিপিও যাওয়া প্রয়োজন।

রিভিউ খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশে বিচারকদের স্বাক্ষরের পর বিকালে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার মাধ্যমে তা কারাগার, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরে পাঠানো হয়।

স্থগিতাদেশের কারণে ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া যেখানে থেমেছিল, সরকারের নির্দেশনা পেলে সেখান থেকেই তা আবার শুরু করা হবে বলে কারা মহাপরিদর্শক মাইন উদ্দিন খন্দকার জানিয়েছেন।   

আদেশে সন্তোষ প্রকাশ করে দুপুরেই ‘বিজয় মিছিল’ বের হয় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে, যাদের আন্দোলনে ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার আইনি সুযোগ তৈরি হয়েছিল, আপিল বিভাগে এসেছিল ফাঁসির রায়।  

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং ফুলবাড়িয়া এলাকায় আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগও আনন্দ মিছিল বের করে।

 

৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সাজা বাড়িয়ে ফাঁসির আদেশ দেয়।

এর আড়াই মাসের মাথায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে সরকারের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার মধ্যরাতে দণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখাও করে আসেন। 

কিন্তু আসামিপক্ষের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ সৈয়দ মাহমুদ হোসেন রাতে এক আকস্মিক আদেশে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করে দেন। ওই রাতেই কাদের মোল্লার পক্ষে পুনর্বিবেচনার আবেদন দাখিল করেন তার আইনজীবীরা।

এই পরিস্থিতিতে বুধবার কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের আদেশের মধ্যে দিয়ে ওই স্থগিতাদেশও উঠে গেল।

ধোপে টেকেনি কোনো যুক্তি

সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানির শুরুতেই কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক এই আবেদনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করেন।

পরে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন তাকে মূল আবেদনের শুনানি (অন মেরিট) শুরু করতে বলেন।

এ সময় ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, রিভিউয়ের গ্রহণযোগ্যতার (মেনটেইনেবল কি-না) বিষয়ে আদালত এখনো কোনো আদেশ দেয়নি। তার আগেই মূল রিভিউয়ের শুনানি কীভাবে হবে?

এ পর্যায়ে বিচারক বলেন, “রিভিউ মেনটেইনেবল না- এটা আমরা বলছি না। আপনি যদি বলেন এটা ‘মেনটেইনেবল’, সে বিষয়েও কোনো তর্কে যাচ্ছি না। আপনাকে অন মেরিট শুনানির সুযোগ দিচ্ছি। আপনি গ্রাউন্ড বলেন।”

এরপর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) বিষয়ে যুক্তি দিতে শুরু করেন কাদের মোল্লার আইনজীবী।

রাজ্জাক বলেন, “মোমেনার সাক্ষ্যে (যে সাক্ষ্যে আপিল বিভাগ ফাঁসির রায় দেয়) অসঙ্গতি রয়েছে। তিনি একেক জায়গায় একেক রকম বক্তব্য দিয়েছেন।... বক্তব্যে অসঙ্গতি থাকলে সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে সেই সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেয়া যায় না।”

বিচারপতি এসকে সিনহা এ সময় বলেন, “সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা আছে বলেই আমরা গ্রহণ করে শাস্তি দিয়েছি।”

এরপর ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আপিলের রায়ে ত্রুটি রয়েছে। তার প্রমাণ হচ্ছে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ওই সাক্ষীকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি বলে তিনি তার রায়ে সাক্ষীর অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন।”

এ পর্যায়ে বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় হয়েছে। যাতে চারজন একমত হয়েছেন। সেখানে আমারটা বলা আমার জন্য বিব্রতকর। সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামতই প্রাধান্য পাবে। আমার মতের কথা বলা হলে আমি বিব্রতবোধ করব।”

এরপর ব্যারিস্টার রাজ্জাক বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ বিষয়ে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ তুলে ধরেন।

তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি দৃষ্টান্ত দেয়ার সময় বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী জানতে চান, সেখানে কি বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ রয়েছে?

রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনাল এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে।

“জেল কোড অনুসারে মুত্যু পরোয়ানা জারি করবে সেই আদালত, যে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়। কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আপিল বিভাগ। তাই পরোয়ানাও জারি করবে আপিল বিভাগ।”

বিচারপতি এসকে সিনহা এ সময় বলেন, “আমাদের আদেশটাই কারা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছে ট্রাইব্যুনাল। আমরা বলেছিলাম, ট্রাইব্যুনাল তা জারি করেছে।”

এরপর বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রশ্ন করেন, কারাবিধি কি কোনো আইন?

প্রধান বিচারপতি এরপরও রাজ্জাককে বক্তব্য চালিয়ে যেতে বললে রাজ্জাক আবার কারাবিধি নিয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। তখন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব হোসেন বলেন, “আপনারাতো আমাদের রায় বিভিউ করতে এসেছেন। রায় নিয়ে বলুন।”

কারাবিধিই অনুসরণ করতে হবে- রাজ্জাকের এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও। তিনি বলেন, রায় কার্যকর হবে আইন (ট্রাইব্যুনাল) অনুযায়ী। 

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংবিধানের ৪৭ (ক)২ অনুযায়ী কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ করার সুযোগ নেই। তিনি কোনো প্রতিকার চাইতে পারেন না। ট্রাইব্যুনাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির আবেদনের সুযোগ থাকবে না। তবে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে শুনতে পারে। আদালত তেমনভাবে এ আবেদন শোনেননি। কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে এ আবেদন করা হয়েছে।

 

মাঝখানে বেলা ১১টা থেকে আধঘণ্টা বিরতি দিয়ে শুনানি চলে বেলা ১১টা ৫০ পর্যন্ত। সর্বশেষ শুনানিতে আব্দুর রাজ্জাক ‘ন্যায় বিচারের স্বার্থে’ মৃত্যুদণ্ড এবং অন্যান্য দণ্ড পুনর্বিবেচনার দুটি আবেদন মঞ্জুর করার আবেদন জানান।

শুনানি শেষে বিচারকরা এজলাস থেকে নেমে যান। এর মিনিট দশেক পরই ‘রিভিউ আবেদন’ খারিজের আদেশ আসে।

এই শুনানি ঘিরে সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা। আদালতে প্রবেশের প্রতিটি ফটকেই পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নেন। আদালত প্রাঙ্গণের ভেতরেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যকে দেখা যায়।

সকাল থেকে সবাইকে তল্লাশি করে আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। শুনানির প্রথম দিন বুধবারও নিরাপত্তার এতোটা কড়াকড়ি দেখা যায়নি।