সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন জামায়াত নেতার আইনজীবীদের আবেদনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করেছেন।
এরপর কী হবে- জানতে চাইলে কাদের মোল্লার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাল উভয় পক্ষের শুনানি হবে।”
“সেখান থেকে প্রয়োজন মনে করলে পূর্ণাঙ্গ আদালতে শুনানি করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে,” বলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের এ্ই উপদেষ্টা।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নাভি পিল্লাই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি পাঠানোর মধ্যে আদালতের স্থগিতাদেশ এল।
এদিকে এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুই না জানানোয় উষ্মা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন দলের সমন্বয়ক এম কে রহমান বলেছেন, পরিস্থিতি ‘অস্বাভাবিক’ মনে হচ্ছে।
জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড ঝুলে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ গণজাগরণ মঞ্চ আবার শাহবাগে লাগাতার অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছে, যাদের অভূতপূর্ব আন্দোলনে যুদ্ধাপরাধের মামলায় আপিলের সুযোগ তৈরি হওয়ায় চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসির আদেশ আসে।
অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় বাস্তবায়নের খবরেই কয়েকটি স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে জামায়াতকর্মীরা। বুধবার হরতাল ডাকার পাশাপাশি দলটি হুমকি দিয়েছে, তাদের নেতার ফাঁসি হলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মৃত্যু নিশ্চিত হবে।
এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে আইন প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু জানান, মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হবে।
এরপর রাত ৮টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ফরমান আলী আরো সুনির্দিষ্ট করে কারফটকে সাংবাদিকদের বলেন, “১২টা ১ মিনিটে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হবে।”
আইন প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনের মধ্যেই খবর আসে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতির বাড়িতে রওনা হয়েছেন আব্দুর রাজ্জাকসহ কাদের মোল্লার আইনজীবীরা।
এর মধ্যে পৌনে ৮টার দিকে কাদের মোল্লার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ২৩ সদস্য কারাগারে ঢোকেন তার সঙ্গে দেখা করতে। সন্ধ্যায় তাদের চিঠি পাঠিয়ে দেখা করতে বলার পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি আরো জোরালো হয়েছিল।
রাত পৌনে ৯টার দিকে তারা বেরিয়ে আসার পর কারাকর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছিল যে ফাঁসির মঞ্চ পুরোপুরি প্রস্তুত। কারাগারের বাইরেও তখন তিন শতাধিক র্যাব-পুলিশের অবস্থান দেখা যায়। বন্ধ করে দেয়া হয় কারাগারের সামনে নাজিমউদ্দিন রোডে গাড়ি চলাচলও।
এদিকে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সঙ্গে কাকরাইলে জাজেস কমপ্লেক্সে তখনো ছিলেন বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আইনজীবী তাজুল ইসলাম।
কারাগারে চূড়ান্ত প্রস্তুতির মধ্যে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ব্যারিস্টার রাজ্জাক চেম্বার বিচারপতির বাড়ি থেকে বেরিয়ে বলেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত রাখার আদেশ পেয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের নিবন্ধক একেএম শামসুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই রকম (স্থগিত) একটি আদেশ এসেছে। আমরা কারাগারে যোগাযোগ করছি।”
তখনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সব প্রস্ততি নিয়ে বসেছিল কারা কর্তৃপক্ষ। রাত পৌনে ১১টার দিকে কাদের মোল্লার আইনজীবী ফরিদ উদ্দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে পৌঁছে সাংবাদিকদের কাছে যখন স্থগিতাদেশের খবর পৌঁছান, তখন সিভিল সার্জনকে ঢুকতে দেখা যায় কারাগারে।
এরপর কারাগারের প্রস্তুতি ঝুলে যাওয়ার বিষয়টি কারা কর্মকর্তাদের আচরণেই ধরা পড়ে।
ঘোষিত সময় ১২টা ১ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ফরমান আলী সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের আদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত রাখা হয়েছে।
‘পরিস্থিতি অস্বাভাবিক’
কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় স্থগিতের আদেশ সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের সমন্বয়ক এম কে রহমান বলেন, তারা এই বিষয়ে কিছুই জানেন না।
মাহবুবে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের কোনো পিটিশনের খবর আমি জানি না। আমরা একটা পক্ষ, কিন্তু পিটিশনের বিষয়ে আমাকে নোটিফাই করা হয়নি।”
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষকে জানানো উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“আমি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আদালতে ছিলাম। আমাকে ফোন করা যেত, কিন্তু আমাকে ফোনও করা হয়নি। যা হয়েছে বা হয়নি, আমাদেরকে না জানিয়ে হয়েছে।”
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি বাসায়। এ বিষয়ে কোনো কিছুই আমরা জানি না।”
“পরিস্থিতি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমাদেরকে জানানো যেত। কিন্তু তা করা হয়নি,” বলেন তিনি।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আপিলের রায়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের এই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ।
জামায়াত নেতার আইনজীবীরা বলে আসছিলেন যে সংবিধান অনুযায়ী আপিল বিভাগের রায় পর্যালোচনার (রিভিউ) আবেদন জানানোর অধিকার কাদের মোল্লারও রয়েছে।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এ বিরোধিতা করে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে আসছেন। এই ধারা অনুযায়ী, গণহত্যাজনিত অপরাধে দণ্ডিতদের মৌলিক মানবাধিকার পাওয়ার সুযোগ নেই।
রাজ্জাকসহ কয়েকজন আইনজীবী মঙ্গলবার সকালেও কারাগারে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন। রাজ্জাক তখন সাংবাদিকদের বলেন, রিভিউ আবেদন করতে তাদের বলেছেন কাদের মোল্লা।
প্রাণভিক্ষা ‘চাননি’ কাদের মোল্লা
শেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে একাত্তরে খুন-ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত কাদের মোল্লার রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের সাতদিনের মধ্যে আসামিকে তা করতে হয়।
তবে কাদের মোল্লা সেই সুযোগ নেননি বলে সন্ধ্যার সংবাদ সম্মেলনে জানান আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল।
তিনি বলেন, “ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে দুজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তিনি অস্বীকার করেছেন। সুযোগ তো বারবার আসে না। সুতরাং আর বিলম্ব করার মতো কোনো কারণ নেই, প্রাণ ভিক্ষাও চাইতে পারবেন না তিনি।”
তখনি তার সঙ্গে থাকা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেন, মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
“কাদের মোল্লার মৃত্যুর যে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, তার পরবর্তী সব বিচারিক কাযক্রম সম্পন্ন হয়েছে। আজ রাতের মধ্যে এ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।”
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল বলেন, “আমরা লক্ষ করেছি কাদের মোল্লার আইনজীবী নানাভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। আজকে তারা মোল্লার সঙ্গে দেখা করেছেন; আইনে এর সুযোগ ছিল না, তারপরও আমরা দেখা করতে দিয়েছি। বাইরে এসে রাজ্জাক সাহেব যা বললেন, তার কোনোটিই আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।”
“রায় পুনর্বিবেচনা বা জেল কোড কার্যকরের কোনো সুযোগ এখানে নেই। এরপরও তারা তিনদিন সময় পেয়েছেন, তারা গত তিনদিনে সে সুযোগ নেননি।”
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের রায়ের পর হরতাল ডেকে দেশব্যাপী নাশকতা চালায় তার দল জামায়াত, যা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের পর ব্যাপকতা পায়।
তবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় সতর্ক রয়েছেন জানিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা সম্ভাব্য নাশকতা ঠেকাতে আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছি। তারা নাশকতা ঠেকাতে সতর্ক রয়েছে।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নিবন্ধক এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ, আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকও ছিলেন বৈঠকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। এ মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই জামায়াতের এই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।
গতবছর ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় তার বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক। এরপর নয় মাস পর রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।
স্থগিতাদেশের পর হরতালের ডাক জামায়াতের
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে নিজেদের জোটের অবরোধের মধ্যেই কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে সোম ও মঙ্গলবার হরতাল ডাকে জামায়াত।
এরপর মঙ্গলবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আদালতের স্থগিতাদেশের পর কাদের মোল্লাকে ‘হত্যার’ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ জানিয়ে তার মুক্তি দাবিতে বুধবারও দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে দলটি।
হরতাল আহ্বান করে এক বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেছেন, “সরকার আব্দুল কাদের মোল্লার সাংবিধানিক অধিকার রিভিউ করার সুযোগ না দিয়ে তাকে হত্যা করে দেশের আইন, সংবিধান ও মানবাধিকারকেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
“মাননীয় চেম্বার জজ মৃত্যুদণ্ডের কার্যকরিতা বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করেছেন। আমরা সুস্পষ্টভাবে সরকারকে বলতে চাই, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্য আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যার প্রয়াস চালানো হলে তা বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে একটি নিকৃষ্ট পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।”
এর আগে সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল হোসেন বলেন, “সরকার সংবিধান, সুপ্রীম কোর্ট রুলস, জেলকোড, আন্তর্জাতিক রীতি নীতি ও সার্বজনীন মানবাধিকারকে ভুলুণ্ঠিত করে আজ রাত ১২.০১ মিনিটে আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
“সরকার আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করলে নিজের রাজনৈতিক মৃত্যুকেই নিশ্চিত করবে।”