এবার ফাঁসির অপেক্ষা

জামায়াতে ইসলামীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছে আপিল বিভাগ, যার ফলে সাজা কার্যকরে আর কোনো বাধা থাকল না।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2013, 08:05 AM
Updated : 5 Dec 2013, 08:05 AM

প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ গত ১৭ সেপ্টেম্বর এই রায় ঘোষণা করে। বিচারকদের স্বাক্ষরের পর সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা বৃহস্পতিবার এই রায় প্রকাশ করে।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া এই রায়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশের পক্ষে ছিলেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

অন্যদিকে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে পাঁচটি অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যে একটি অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল বিচারিক আদালত, আপিলের রায়ে তাতে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। অন্য চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের শাস্তিই বহাল রাখা হয়েছে। আর ছয় নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশের বদলে আপিল বিভাগ দিয়েছে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ।

৭৯০ পৃষ্ঠার এই রায়ের মূল অংশটি লেখেন বিচারপতি এস কে সিনহা। এতে বলা হয়, ষষ্ঠ অভিযোগে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। মৃত্যু পর্যন্ত তাকে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

রায় ঘোষণার আড়াই মাসেরও বেশি সময় পর এর পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পেল।  বৃহস্পতিবার রায় প্রকাশের পর বিকালেই কাদের মোল্লাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়।

‘মৃত্যুদণ্ডই যথার্থ সাজা’

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৬ মার্চ কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় যান। সেখানে কাদের মোল্লার নির্দেশে লস্করের স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়। এক মেয়ে হন ধর্ষণের শিকার।

রায়ে বলা হয়, “অপরাধের মাত্রা যদি কাদের মোল্লার সাজার ভিত্তি ধরা হয়, তাহলে ছয় নম্বর অভিযোগ কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। যেখানে হত্যা এবং ধর্ষণ মতো অপরাধ রয়েছে। এটা বর্বরোচিত, ঠাণ্ডা মাথার খুন ও নিষ্ঠুরতম।”

হযরত আলী লস্করের মেয়ে মোমেনা বেগম ছিলেন এ মামলার তিন নম্বর সাক্ষী, যিনি নিজেও সেদিন ধর্ষেণের শিকার হন। ট্রাইব্যুনালে তার দেয়া জবানবন্দির ভিত্তিতেই কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ।

মামলার তিন নম্বর সাক্ষীর বক্তব্য উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, “এটি এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী হত্যাকাণ্ড, যার জন্য যাবজ্জীবন সাজা অপর্যাপ্ত, মৃত্যুদণ্ডই যার উপযুক্ত সাজা। কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অংশ নেন। এই অপরাধ সংগঠনের জন্য তিনি সর্বোচ্চ সাজা এড়াতে পারেন না।

“তার এ বর্বর অপরাধ মানবজাতির বিবেককে দারুণভাবে আহত ও স্তম্ভিত করে। এ কারণেই ৬ নম্বর অভিযোগে কাদের মোল্লাকে ট্রাইবুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের  রায় বিবেচনাপ্রসূত হয়নি এবং সাজা প্রদানের নীতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে।… এই অপরাধের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডই কাদের মোল্লার একমাত্র যথার্থ দণ্ড।”

 

এবার বাস্তবায়ন

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে কাদের মোল্লার মামলার রায়ই প্রথম সাজা কার্যকরের পর্যায়ে এলো। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের পর সংশোধিত আপিল আইনের আওতায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত এই যুদ্ধাপরাধীর।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর উপ-কারা মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রায়ের অনুলিপি হাতে পেলেই তারা কারা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

কারা বিধি অনুযায়ী, সাধারণ ফৌজদারী মামলায় চূড়ান্ত আপিল খারিজের রায় বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়।এরপর বিচারিক আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। 

কারাবিধি অনুযায়ী রায় ঘোষণার দিন থেকে ৭ দিনের মধ্যে কাদের মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন।  এ অবেদন নাকচ হলে তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে।

অবশ্য কাদের মোল্লার মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে হওয়ায় কারাবিধি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। 

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের সমন্বয়ক এম কে রহমান বলেন, “আইন অনুসারে সরকারের সিদ্ধান্তে এই রায় বাস্তবায়ন হবে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার চাইলে জেল কোডও অনুসরণ করতে পারে।”

কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “দ্রুততম সময়ের মধ্যেই রায় কার্কর হবে, ওয়েট অ্যান্ড সি। রায় কার্যকরে এখন আর কোনো বাধা নেই।”

তিনি বলেন, এই রায় নিয়ে ‘রিভিউ পিটিশন’ করার কোনো সুযোগ নেই। রায় কার্যকরের সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমাও নেই।

অবশ্য কাদের মোল্লার আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাকের দাবি, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে এই জামায়াত নেতারও ‘রিভিউ পিটিশন’ করার অধিকার আছে।রায়ের সত্যায়িত কপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তারা এই ‘পিটিশন’ করবেন।

 

গণজাগরণে আপিল

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে একাত্তরে হত্যাকাণ্ডের একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত শুরু হয়।

গত বছরের ২৮ মে বিচার শুরু করে গত ৫ মে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে সাজার রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

রায়ের প্রতিবাদে ওইদিনই শাহবাগে গণজাগরণ আন্দোলনের সূচনা হয়। সর্বস্তরের মানুষের অভূতপূর্ব সেই অহিংস সমাবেশ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার দাবি ওঠে।

এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে প্রসিকিউশন ও আসামি উভয় পক্ষের আপিলের সমান সুযোগ তৈরি করা হয়। আগের আইনে শুধু আসামির খালাসের ক্ষেত্রেই প্রসিকিউশন আপিল করতে পারত।

আইন সংশোধনের পর প্রসিকিউশন সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে। সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আপিল করেন কাদের মোল্লা।

গত ১ এপ্রিল আপিলের শুনানি শুরু হয়। তখন আসামি পক্ষ প্রশ্ন তোলে, কাদের মোল্লার রায়ের পর আইন সংশোধন হওয়ায় তার ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনের প্রয়োগ করা যাবে কি না।

এই বিষয়টির সুরাহায় অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের সাত আইনজীবীর বক্তব্য শুনে আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত নেয়, কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সংশোধিত আইন কার্যকর হবে।

সাড়ে পাঁচ মাস শুনানির পর ১৭ সেপ্টেম্বর আসামি পক্ষের আপিল আবেদন খারিজ করে দিয়ে প্রসিকিউশনের আপিল আবেদন গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

মামলার ইতিবৃত্ত

মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। এছাড়া ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরেকটি মামলা হয় কাদেরের বিরুদ্ধে। এ মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই জামায়াতের এই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১১ সালের ১ নভেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

গতবছর ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় তার বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক।

দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। এর পক্ষকাল পর কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।