বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত পৌনে ৩টায় কংগ্রেসের পররাষ্ট্র-বিষয়ক উপ-কমিটিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এই শুনানি হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ ইন টারময়েল: এ নেশন অন দ্য ব্রিংক?”
কংগ্রেসের পররাষ্ট্র-বিষয়ক উপ কমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবটের সভাপতিত্বে এই শুনানিতে কংগ্রেস সদস্য ব্র্যাড শারমেন, তুলসি গ্যাবার্ড, গ্রেস মেং ও জেরার্ড ই কোনোলি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
পরে প্যানেল আলোচক হিসাবে বক্তব্য দেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের পাবলিক পলিসি স্কলার আলী রিয়াজ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট এ এন এম মুনীরউজ্জামান ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর জন শিফটন।
প্রায় দেড় ঘণ্টার শুনানিতে প্যানেল আলোচকদের বক্তব্য শেষে কিছু সময় প্রশ্নোত্তর চলে। সবশেষে বক্তব্য দেন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র-বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস।
নভেম্বরের শুরুতে ঢাকা ঘুরে যাওয়া শ্যাবট শুনানির শুরুতেই বলেন, তার সফরের সময় বাংলাদেশে বিরোধী দলের হরতাল চলছিল, যেখানে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে তার মনে হয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
শ্যাবট বলেন, ওই সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কিন্তু তাদের দুজনই নিজেদের অবস্থানে অনঢ়। বিরোধী দল নির্বাচনে যাবে কি না- সে বিষয়টিও এখনো নিশ্চিত নয়।
নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকলে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই কংগ্রেস সদস্য।
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে অভিযোগ পেয়েছেন জানিয়ে শ্যাবট বলেন, রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে হেনস্তার জন্যে এ ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে বলে তার কাছে অভিযোগ করা হয়েছে।
কংগ্রেসের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় তিনি উদ্বিগ্ন।
পাকিস্তানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা ও মৌলবাদের উত্থান নিয়ে সতর্ক হওয়ারও তাগিদ দেন।
রয়েস বলেন, জঙ্গিবাদের উত্থানের বিষয়টিতে সতর্ক থেকে এখনই বাংলাদেশের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
প্যানেল আলোচক আলী রিয়াজ চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকার বিরোধী দলের মেনে না নেয়ার ইঙ্গিত থাকায় শেখ হাসিনার পরিবর্তে অন্য কারো নেতৃত্বে সর্বদলীয়/নির্বাচনকালীন সমরকার গঠিত হতে পারে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে তিন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে তার ধারণা।
প্রথম সম্ভাবনায় তিনি বলেন, সব দলকে নিয়েই স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন হতে পারে। তবে দুই দলের বর্তমান অনড় অবস্থানে সে সুযোগ কম।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা হিসাবে আলী রিয়াজ বলেন, এবারো বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচন হতে পারে, যদিও বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৯৬ সালের মতো নয়।
এছাড়া একতরফা নির্বাচন ‘কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায় না’ বলে বিরোধী দলকে সাথে নিয়েই নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিৎ বলে মত দেন তিনি।
তৃতীয় সম্ভাবনায় নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার কথা বলেন আলী রিয়াজ। তার ভাষায়, এতে আপাতত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে মনে হলেও তা শেষ পর্যন্ত প্রধান দুই দলের বৈরিতা কমানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
“গোলযোগ সৃষ্টি হলে তা নিয়ে নাক গলানোর পরিবর্তে এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ায় শ্রেয়।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল মুনীরউজ্জামান বলেন, বর্তমান সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তা না হলে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটতে পারে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রক্রিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক মান রক্ষা হচ্ছে না বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক জন শিফটন বলেন, এ বিচার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ‘ন্যায়-নিষ্ঠভাবে’ হচ্ছে না। বাংলাদেশে মানবাধিকার বিপন্ন। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সমুন্নত রাখতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
অবশ্য ড. আলী রিয়াজ বলেন, একাত্তর সালে ৩০ লাখ বাঙালিকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হতেই হবে। তা না হলে বাংলাদেশে আইনের শাসনের প্রত্যাশা মুখ থুবড়েই থাকবে।
বিচার ব্যবস্থায় ঘাটতি বা কোনো ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা যেতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু ওই বিচার বন্ধ করা চলবে না। এটি বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের দাবি। একাত্তরে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্বজনেরা বিচার দেখে যেতে চান।”
কংগ্রেস সদস্য গ্রেস মেং তার বক্তব্যে পোশাক শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়নে আন্তর্জাতিক মহলের পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন।
এছাড়া পোশাক খাতে যে সব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর সমাধানে বাংলাদেশ সরকার শিগগিরই শ্রম আইনকে ঢেলে সাজাবে বলেও তিনি প্রত্যাশা করেন।