মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের আমৃত্যু কারাদণ্ডে সন্তুষ্ট নন বলে জানিয়েছেন তার এলাকা জয়পুরহাটের মুক্তিযোদ্ধা ও স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা।
Published : 09 Oct 2013, 04:40 PM
তবে আলীমের স্বজনরা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন।
বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আব্দুল আলীমের আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়।
আব্দুল আলীমের জ্যেষ্ঠ ছেলে কানাডা প্রবাসী ফয়সাল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা বাবার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনো বিত্তি নেই।
ট্রাইব্যুনালে আনা সব সাক্ষী ভাড়া করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
জয়পুরহাটের খঞ্জনপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাদি ও আবুল হোসেন (সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার) বলেন, আব্দুল আলীম ছিলেন হানাদার বাহিনীর তালিকাভুক্ত রাজাকার এবং তখনকার জয়পুরহাট মহুকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান।
যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তারা বিভিন্ন জনের মুখে শোনেন, আলীমের নিদের্শে ও পরিকল্পনায় মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জয়পুরহাটের কড়ই কাদিরপুরে হিন্দু পল্লীতে স্থানীয় রাজাকাররা পাক সেনাদের নিয়ে মা-বোনদের ইজ্জৎ লুন্ঠন করে এবং ৩৭১ জন হিন্দু মৃৎ শিল্পীকে সাড়িবদ্ধভাবে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করে।
চোখের সামনে বাবা, দাদাসহ একই পরিবারের ২১ জন নিহত হন বলে ডুকরে কাঁদেন দরিদ্র ফটোগ্রাফার রঞ্জিত কুমার ওরফে দশরথ।
এ মামলার অন্যতম সাক্ষী মোল্লা শামছুল আলম জানান, ১৯৭১ সালে আব্দুল আলীমের নিদের্শে ও পরিকল্পনায় জেলায় ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুকি এলাকার অনেক লোক জানান, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শরনার্থীরা ভারতে যাওয়ার পথে সীমান্তবর্তী এলাকা জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ান এলাকায় আব্দুল আলীমের নেতৃত্বে পাক সেনারা প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা এবং শত শত নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করে।
পাগলা দেওয়ান গণকবব এলাকার প্রত্যক্ষদশী এবং হানাদার বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনের শিকার আবু সালেম, জলিল মিয়া, গণহত্যায় স্বজনহারা ধীরেন্দ্র নাথ সোনারসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে প্রতিক্রিয়া নেয়া হয়।
তারা জানান, আলীমের এ রায়ে তারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
জেলা শহরের মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম সোলায়মান আলী, আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম হাক্কানী জানান, এ রায়ে গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোসহ স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে অনুরোধ করেন তারা।
মানবতা বিরোধী অপরাধে গত বছর ২৭ মার্চ জয়পুরহাটের নিজ বাস ভবন থেকে গ্রেপ্তার হন আব্দুল আলীম।
১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল আলীম। তার বাবা আবদুল ওয়াহেদ ছিলেন জয়পুরহাট শহরের থানা রোডের ইসলামিয়া রাইস মিলের মালিক। আদি বসত পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় হলেও দেশবিভাগের পর ১৯৫০-৫১ সালে তাদের পুরো পরিবার তখনকার পূর্ব বাংলার (পাকিস্তান) জয়পুরহাটে চলে আসে।
আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার পর আইন পেশায় যোগ দেন আলীম। ১৯৫৮ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার চার বছরের মাথায় দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, আলীম তখন কনভেনশন মুসলিম লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং বগুড়া জেলা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। সে সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য মহুকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন।
তার নেতৃত্বে সে সময় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ব্যাপক ধরপাক, লুটপাট, নির্যাতন এবং হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছিল আলীমের বিরুদ্ধে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর এবং ১৯৭৭ সালে দুই দফা জয়পুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলীম। ১৯৭৯, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি বিএনপির টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জিয়াউর রহমানের সরকারে প্রথমে বস্ত্রমন্ত্রী এবং পরে যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন আলীম।