স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের নেতা হিসাবে একাত্তরে জয়পুরহাটে রাজাকার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর দায়ে আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
Published : 09 Oct 2013, 12:42 PM
আলীমের রায় প্রশ্নবিদ্ধ: মির্জা আব্বাস
জাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ, আপিলের দাবি
‘আলীমের পঙ্গুত্ব খতিয়ে দেখা দরকার’
আলীমের রায়ে ‘প্রতিক্রিয়া নেই’ আইন মন্ত্রণালয়ের
রায় আমাদের মানতে হবে: প্রসিকিউশন
জনগণের প্রত্যাশা ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি: হানিফ
হত্যা, গণহত্যার মতো অপরাধে ‘মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হলেও’ বয়স ও পঙ্গুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে ৮৩ বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধীকে বাকি জীবন কারাগারে কাটানোর এই সাজা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
জিয়াউর রহমানের আমলের মন্ত্রী আলীম হলেন বিএনপির দ্বিতীয় নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে যার সাজার আদেশ হলো। সাবেক মন্ত্রী হিসাবে এ দিক দিয়ে তিনি তৃতীয়।
বুধবার এই রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৭টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি ঘটনায় আলীমের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ঘটনায় আলীম যেভাবে গণহত্যা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন- তা ‘অত্যন্ত জঘন্য’ অপরাধ।
“কোনো মানুষ, যে ফিজিক্যালি ও মেন্টালি আনফিট, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিৎ নয়। কিন্তু আবদুল আলীমের অপরাধ এতোটাই ঘৃণ্য, তাকে মুক্ত রাখলে মানবতার অবমাননা হবে। এ কারণে তাকে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বাকি জীবন কাটাতে হবে। তাহলে হয়তো কৃতকর্মের জন্য তার ভেতরে অনুশোচনার সৃষ্টি হবে।”
রায়ের সময় কাঠগড়ায় হুইল চেয়ারে বসে ঝিমাতে দেখা যায় আবদুল আলীমকে। চূড়ান্ত রায়ের পর ছেলের কাছে তিনি জানতে চান- ‘কী হয়েছে?’
এর আগে একই কারণে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকেও মৃত্যুদণ্ডের বদলে ৯০ বছরের জেল দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই মামলা বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত দালাল আইনের আসামি ছিলেন আলীম।
একজন আইনজীবী হয়েও কীভাবে আলীম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধের নয়টি মাস একের পর এক হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছেন, তা উঠে এসেছে এই রায়ে। মামলার শুনানিতে ওইসব ঘটনার জন্য তাকে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবল’ হিসাবে উল্লেখ করে প্রসিকিউশন।
সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া কনভেনশন মুসলিম লীগের এই নেতা জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে কীভাবে রাজাকার বাহিনীর জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, কীভাবে এক পাট ব্যবসায়ীর গদিঘর দখল করে নির্যাতন শিবির খোলেন- সে বিবরণও এই রায়ে উঠে এসেছে।
তারপরও ফাঁসির রায় না আসায় ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষায় থাকা অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা অসন্তোষ প্রকাশ করে। আপিলের মাধ্যমে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়ারও দাবি জানান তারা।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আহসানুল হক হেনাও রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রসিকিউশন বলছে, আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি আশা করলেও আদালতের রায় তারা মেনে নিচ্ছে।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না- পুরো রায় দেখে সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এটি অষ্টম রায়। আগের সাতটি রায়ে জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান ছয়জন এবং বিএনপির এক নেতাকে দণ্ডাদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আপিলের রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
বুধবারবার সকাল ১০টা ৪৯ মিনিটে এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রায়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর ১৯১ পৃষ্ঠার এই রায়ের রায়ের সংক্ষিপ্তসারের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম।
ট্রাইব্যুনালের অপর বিচারক মো. মুজিবুর রহমান মিয়া রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়ার পর বেলা ১২টা ৩৫ মিনিটে সাজা ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
রায়ের সূচনা বক্তব্যে ট্রাইব্যুনাল প্রধান বলেন, “এটি এ ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়। প্রতিটি রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন মন্তব্য করা হয়। উভয় পক্ষই তা করে। তবে রায়ের সংক্ষিপ্তসার দেখেই তা করা হয়। এটা ঠিক না।
“পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে সুইপিং রিমার্ক করলে আইনের শাসনের ক্ষতি হয়।”
এর আগে সকাল ৯টা ৪৭ মিনিটে একটি সাদা রংয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে আসামি আলীমকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে হাই কোর্টসংলগ্ন ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে তাকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়। এ সময় তার পরনে ছিল সাদা লুঙ্গি ও ফতুয়া।
রায় ঘোষণা শেষ হওয়ার পর আলীম তার মেজো ছেলে সাজ্জাদ বিন আলীমের কাছে জানতে চান- ‘কী হয়েছে?’
জবাবে ছেলে বলেন, “আটটাতে খালাস। বাকিগুলোতে কারাদণ্ড দিয়েছে। চিন্তা করবেন না।”
এরপরই পুলিশ এসে সরিয়ে দেয় সাজ্জাদকে। আলীমকে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের নিচতলার হাজতখানায়।
আদালতে আলীমের দুই ছেলে সাজ্জাদ বিন আলীম এবং খালিদ বিন আলীম উপস্থিত ছিলেন। কাঠগড়া সংলগ্ন সামনের সারিতে অন্য তিনজন স্বজনকে নিয়ে বসেন সাজ্জাদ। তার সামনের সারিতে বসেন খালিদ বিন আলীম।
ফয়সাল বিন আলীম এবং সদরুল আলীম নামে আলীমের আরো দুই ছেলে রয়েছে। সদরুল আলীম এবং একমাত্র মেয়ে কানাডাপ্রবাসী। বড় ছেলে ফয়সাল বিন আলীমও বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন।
সাজ্জাদ বিন আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাবাকে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে আনার পর ট্রাইবুনালেই খাওয়া দাওয়া করানো হয়। এরপর তাকে ট্রাইব্যুনাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে, কারা হেফাজতে।
রায়কে ঘিরে সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্ট সংলগ্ন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদের বরাবরের মতোই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি করে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।
আগের রায়ের দিনগুলোর মতো এদিনও সকাল থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মিছিল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের ট্রাইব্যুনালের বাইরে জড়ো হতে দেখা যায়। তারা বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করারও দাবি জানান।
প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর তাৎক্ষণিকভাবে ট্রাইব্যুনালের বাইরে ও শাহবাগে অসন্তোষের প্রকাশ দেখা গেলেও প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ রায় তারা মেনে নিয়েছেন।
এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের রায় আমাদের মানতে হবে। আমরা অবনত মস্তকে মেনে নিচ্ছি। তবে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী রায় হলে আমাদেরও ভালো লাগতো।”
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, “আব্দুল আলিম যে যুদ্বাপরাধী তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। আদালত তার শারীরিক অক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে।”
রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় না বলে ‘সর্বোচ্চ সাজা’ পাওনা হওয়ার পরও ট্রাইব্যুনাল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি দেখে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অন্যদিকে আলীমের আইনজীবী আহসানুল হক হেনা রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমরা আপিল করব।”
আলীমের বড় ছেলে কানাডাপ্রবাসী ফয়সাল আলীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার বাবার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।
আলীমের দল বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো না হলেও ‘ব্যক্তিগতভাবে’ এ রায় নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
তিনি বলেন, “আমরা সব সময় বলে আসছি, বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে। তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের।… কিন্তু যেসব বিচারের রায় হচ্ছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। জনমনে এ নিয়ে নানারকম প্রশ্ন রয়েছে।”
ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “জনগণের প্রত্যাশা ছিল এ নরঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। তবে রায়ের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।”
আইন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন আইন মন্ত্রী শফিক আহমেদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেবেন না।
অন্যদিকে হত্যা-গণহত্যার মতো অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও আলীমের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
ট্রাইব্যুনালের একটি যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাক্ষ্য দেয়া মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক বলেন, “আমি এটাকে একটা হুইল চেয়ার ভার্ডিক্ট বলব। উনি হুইল চেয়ারে চড়ছেন কি না সেটা বিবেচনা করে রায় দেয়া হয়েছে।”
এতো খুন-খারাবির পরেও সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে বাংলাদেশে আর কখনো খুন-খারাবি বন্ধ হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জমানও বলেছেন, আলীমের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আদালত যে রায় দিয়েছে, তাতে জনগণের প্রতাশ্যা পূরণ হয়নি।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, কিছু দিন আগে আলীম পালানোর চেষ্টা করেছিলেন বলে তিনি শুনেছেন। তিনি সত্যি সত্যি পঙ্গু কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।
আলীমের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সহ সভাপতি এ কে এম শফিউল্লাহ আপিল করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “আলীমের যে জঘন্যতম অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে তাতে ফাঁসির নিচে কোনো দণ্ড হওয়া ঠিক নয়। নাৎসিদের কঙ্কাল এনে যদি ফাঁসিতে ঝুলানো যায়, তাহলে আলীমকে নয় কেন?”
ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক এম এ হাসান রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে তা সবাইকে মানতে হবে। এ রায়ের মাধ্যমে অপরাধের সঙ্গে বসবাসের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”
অসন্তোষ জানিয়েছে আলীমের নিজের জেলা জয়পুরহাটের মানুষও।
জয়পুরহাটের খঞ্জনপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাদি বলেন, আব্দুল আলীম ছিলেন হানাদার বাহিনীর তালিকাভুক্ত রাজাকার এবং তখনকার জয়পুরহাট মহুকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান।
এ মামলার অন্যতম সাক্ষী মোল্লা শামছুল আলম বলেন, ১৯৭১ সালে আব্দুল আলীমের নিদের্শে ও পরিকল্পনায় জেলায় ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তারপরও তার সর্বোচ্চ সাজা হলো না।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসা গণজাগরণ মঞ্চ রায়ের পরপরই শাহবাগে বিক্ষোভ মিছিল করে।
মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “এ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমরা এ রায়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশা ব্যক্ত করছি।
“আমরা বিশ্বাস করি আপিলের মাধ্যমে প্রত্যাশিত রায় পাব।”
১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল আলীম। তার বাবা আবদুল ওয়াহেদ ছিলেন জয়পুরহাট শহরের থানা রোডের ইসলামিয়া রাইস মিলের মালিক। আদি বসত পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় হলেও দেশবিভাগের পর ১৯৫০-৫১ সালে তাদের পুরো পরিবার তখনকার পূর্ব বাংলার (পাকিস্তান) জয়পুরহাটে চলে আসে।
আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার পর আইন পেশায় যোগ দেন আলীম। ১৯৫৮ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার চার বছরের মাথায় দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, আলীম তখন কনভেনশন মুসলিম লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং বগুড়া জেলা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। সে সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য মহুকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন।
তার নেতৃত্বে সে সময় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ব্যাপক ধরপাক, লুটপাট, নির্যাতন এবং হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছিল আলীমের বিরুদ্ধে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর এবং ১৯৭৭ সালে দুই দফা জয়পুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলীম। ১৯৭৯, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি বিএনপির টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জিয়াউর রহমানের সরকারে প্রথমে বস্ত্রমন্ত্রী এবং পরে যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন আলীম।
মামলার পূর্বাপর
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ জয়পুরহাটের বাড়ি থেকে আলীমকে গ্রেফতার করা হয়। ৩১ মার্চ তাকে ১ লাখ টাকায় মুচলেকায় ছেলে টেলিকম খাতের ব্যবসায়ী ছেলে ফয়সাল আলীম ও আইনজীবী তাজুল ইসলামের জিম্মায় জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর কযেক দফায় জামিনের মেয়াদ বাড়ানোয় ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ছেলের বাড়িতেই ছিলেন।
ফয়সাল আলীম মোবাইল ফোনের কনটেন্ট প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান উইনটেলের মালিক।
গত বছরের ১৫ মার্চ আলীমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন, যাতে হত্যা, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৮টি অভিযোগ আনা হয়। এরই মধ্যে গত বছরের ১৬ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।
গত বছরের ১১ জুন ৭ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৭টি অভিযোগে আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ নের মধ্য দিয়ে এই বিএনপি নেতার বিচার শুরু হয়।
গতবছর ৬ আগস্ট এ মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। চলতি বছরের ২২ অগাস্ট প্রসিকিউশনের ৩৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়।
অন্যদিকে আসামিপক্ষে তার ছেলে সাজ্জাদ ছাড়াও সাক্ষ্য দেন জয়পুরহাটের বাসিন্দা মো. মামুনুর রশিদ চৌধুরী ও মো. মোজাফফর হোসেন। সাফাই সাক্ষ্য চলে ২৭ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে ট্রাইব্যুনাল।
অষ্টম রায়
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।
৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়।
ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে গত ২৮ ফেব্র“য়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।
এরপর গত ৯ মে চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উস্কানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গত গত ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।
ষষ্ঠ রায়ে গত ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকেও মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
আর সর্বশেষ গত ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের সপ্তম রায়ে সাবেক মন্ত্রী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্র ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে।
(ট্রাইব্যুনালের বাইরে ও বার্তা কক্ষ থেকে এই প্রতিবেদনে বাড়তি তথ্য যোগ করেছেন লিটন হায়দার, সুমন মাহবুব, মঈনুল হক চৌধুরী, কামাল তালুকদার, গোলাম মুজতবা ধ্রুব, সাজিদুল হক, ফয়জুল সিদ্দিকী, ফারহান ফেরদৌস, আজিজ হাসান, মাহবুবা ডিনা ও নাহিদ আশরাফী।)