রূপপুরে নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই: প্রধানমন্ত্রী

পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এর মধ্যে দিয়ে পুরো জাতির একটি স্বপ্ন পূরণ হলো।

রিয়াজুল বাশারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2013, 07:10 AM
Updated : 25 Dec 2015, 03:36 PM

এ প্রকল্পের নিরপত্তা নিশ্চিতে সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এটি নতুন মাইল ফলকে পৌঁছাল।

প্রধানমন্ত্রী আশা করছেন, এ প্রকল্পের দুই ইউনিটের কাজ শেষে ২০২১ সালের মধ্যে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। এ জন্য ব্যয় হবে তিন থেকে চারশ কোটি ডলার।

বুধবার সকাল ১১টা ২১ মিনিটে রূপপুর প্রকল্পের মাঠে এই ‘স্বপ্নের প্রকল্পের’ প্রথম পর্যায়ের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী পৌঁছানোর আগেই রূপপুরে রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট ও বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশন একটি চুক্তি করে। ২৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এই চুক্তি অনুযায়ী অ্যাটমস্ট্রয় পরমাণু কেন্দ্রের নকশা করে দেবে।

রাশিয়ান ফেডারেশনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও রাশিয়ার আনবিক শক্তি কর্পোরেশন রোসাটমের মহা পরিচালক সের্গেই ভি কিরিয়েনকোও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হেলিকপ্টারে করে রূপপুরে নামার পর সরাসরি প্রকল্প মাঠে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। ভিত্তিফলক উন্মোচনের পর তিনি মুনাজাতে অংশ নেন।  

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে সহযোগিতার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজকের দিনটি শুধু রূপপুরবাসী নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির একটি স্বপ্ন পূরণের দিন।”

এ প্রকল্পের জন্য ‘দীর্ঘদিন ধরে জমি দিয়ে বসে থাকা’ রূপপুরবাসীরও অপেক্ষার অবসান হলো বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ প্রকল্পের ইতিহাস তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, “১৯৯৬ সালে আমরা সরকার পরিচালনার দ্বায়িত্ব নিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের কাযক্রম হাতে নেই। আমরা অনেক দূর এগিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরের বার আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি।”

তখনকার বিএনপি সরকারের সমালোচনায় শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে ৪৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছিলাম। বিএনপি ক্ষমতায় এসে ৪৩০০ মেগাওয়াট থেকে ৩২০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে এনেছিল। তারা দেশকে তো এগিয়ে নিতে পারেইনি,  আরো পিছিয়ে দিয়েছে।”

বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা তুল ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের কমপক্ষে ১০ শতাংশ পরমাণ বিদ্যুৎ থেকে আসবে।

সরকারপ্রধান বলেন, রূপপুর প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে নিরাপত্তা নিয়ে।

“পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি পারমাণবিক নিরাপত্তার ওপর। এ জন্য আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ-র নীতিমালা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করছি।”

“যে কোনো ধরনের দুর্যোগে এই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকটা খেয়াল রেখে এ প্ল্যান্টের ডিজাইন করা হচ্ছে। আমি রাশিয়ার মান্যবর রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেছি, নিরাপত্তার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করে যেন এ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। তিনি আমাকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন।”

পদ্মা নদীর তীরে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিচ্ছে রাশিয়ার পারমাণবিক জ্বালানি সংস্থা রোসাটম। তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুয়ায়ী, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে রুশ সরকার। কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানিও তারা সরবরাহ করবে এবং বর্জ্য ফেরত নেবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যে কোনো পারমাণবিক কেন্দ্রের বড় দুশ্চিন্তার কারণ তার ব্যবহৃত জ্বালানি বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। রাশিয়া এসব বর্জ্য তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাবে এটা চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।”

প্রধানমন্ত্রী দেশের বিদ্যুত খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, বিগত সাড়ে চার বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৯ হাজার ৭১৩ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে, যা  সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের সময়ের দ্বিগুণেরও বেশি।

“প্রমাণ করেছি, আমরা কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী।” 

অনুষ্ঠানে উপস্থিত রোসাটমের মহাপরিচালক সের্গেই কিরিয়েংকো বলেন, “শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক বিদ্যুত ব্যবহারের অধিকার বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে।”

তিনি বলেন, জাপানের ফুকোশিমা দুর্ঘটনার পর আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার নীতিমালা আরো কঠোর হয়েছে। আইএইএ-র সব ধরনের চাহিদা পূরন করেই এ প্রকল্প তৈরি করা হবে।

টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এ প্রকল্প ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন রোসাটম পরিচালক।

১৯৬১ সালে পরামাণু কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার পর ১৯৬৩ সালে প্রস্তাবিত ১২টি এলাকার মধ্য থেকে বেছে নেয়া হয় রূপপুরকে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রায় ৫০ বছর আগের নেয়া উদ্যোগ সক্রিয় করে তোলা হয়। দ্রুত পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ২০১০ সালে সংসদে প্রস্তাবও পাস করা হয়, গঠন করা হয় একটি জাতীয় কমিটি।

ওই বছরই রাশিয়ার সঙ্গে একটি কাঠামো চুক্তি করে সরকার এবং ২০১১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ দুই দেশ চুক্তি করে। দুই ইউনিটের দুই হাজার মেগাওয়াট উতপাদন ক্ষমতার প্রস্তাবিত এ কেন্দ্রের জন্য আগেই অধিগ্রহণ করা হয় ২৬২ একর জমি।

রাশিয়া থেকে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্বলিত সর্বাধুনিক তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি দিয়ে রূপপুরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির মানের ওপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিটের প্রতিটি স্থাপনে ১৫০ থেকে ২০০ কোটি ডলার ব্যয় হতে পারে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

এই নির্মাণ ব্যয়ের ১০ শতাংশের অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ সরকার, বাকি ৯০ শতাংশ রাশিয়া ঋণ হিসাবে দেবে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ হবে ৬০ বছর। পরে তা আরো ২০ বছর তা বাড়ানো যাবে।