বড় কাটরা-ছোট কাটরা: আইনে আছে, মানচিত্রে নেই

রাজধানীর ঐতিহাসিক ও নান্দনিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে হেরিটেজ আইন প্রণয়ন হলেও রাজউকের মানচিত্রে বিশেষ অঞ্চল হিসেবে স্থান না হওয়ায় ঝুঁকির মুখে রয়েছে মুঘল স্থাপত্য বড় কাটরা ও ছোট কাটরা।

আশিক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2013, 11:55 AM
Updated : 20 Sept 2013, 01:07 PM

২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নান্দনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ৯৩টি ভবন, শাঁখারীবাজার এলাকা এবং ফরাশগঞ্জ, সূত্রাপুর এলাকার নয়টি সড়ককে সংরক্ষিত ঘোষণা করে হেরিটেজ আইন প্রণয়ন করা হয়।

সেই আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত এসব ভবনের আড়াইশ’ মিটারের মধ্যে (যা মূল ভবনটির সৌন্দর্যের ক্ষতি করে) কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। ভবনগুলোতে সংস্কার চালানোর বিষয়েও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। সংরক্ষিত এ ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বড় কাটরা ও ছোট কাটরা।

হেরিটেজ আইনে এই দুটি স্থাপত্যকে ‘প্রোটেকশন’ দেয়ার কথা বলা হলেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) এর মানচিত্রেও বিশেষ অঞ্চলের মর্যাদা পায়নি স্থাপত্য দুটো।

ড্যাপে লালবাগ কেল্লা এবং সেন্ট্রাল জেলসহ পুরান ঢাকার আরো কয়েকটি সংরক্ষিত স্থাপনায় বাদামি রং দিয়ে চিহ্নিত করা থাকলেও বড় কাটরা বা ছোট কাটরায় কোনো চিহ্ন নেই।

এতে ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘চাপে’ বড় কাটরা ও ছোট কাটরা বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর কেন এই স্থাপত্য দুটি ড্যাপে বিশেষ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়নি, তার সদুত্তর মেলেনি রাজউক কর্মকর্তাদের কাছে।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা তৈরিতে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছে আরবান স্টাডি গ্রুপ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

ওই প্রতিষ্ঠানের সিইও তৈমুর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ড্যাপের মানচিত্রে ছোট কাটরার আংশিক অস্তিত্ব প্রকাশ পেলেও বড় কাটরার কোনো চিহ্ণ নেই।

“এখন কেউ যদি ওই এলাকায় ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের অনুমোদন চান, সেক্ষেত্রে যিনি অনুমোদন দেবেন তিনি তো এই ম্যাপ দেখেই অনুমোদন দেবেন। ভবন নির্মাণ হয়ে গেলে ক্ষতি যা হওয়ার, তা তো হয়েই যাবে।”

পুরান ঢাকার প্রাচীন ভবনগুলো ভেঙে ফেলে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির প্রবণতা চলতে থাকায় বড় কাটরা ও ছোট কাটরার অস্তিত্ব থাকা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তৈমুর আহমেদ।

“এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের, তারা কি আসলেই তাদের দায়িত্ব পালন করছে,” প্রশ্ন করেন তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, চাম্পাতলি লেনে ছোট কাটরার দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একটি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রায় দুই মাস আগে ওই ভবন নির্মাণ শুরু হলে রাজউক তা বন্ধ করে দেয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় ওই ভবনটি নির্মাণ শুরু হয়।

তিনি বলেন, “একসময় ছোট কাটরার সামনে কোনো ধরনের স্থাপনা ছিল না। কিন্তু এখন ছোট-বড় অসংখ্য স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে ছোট কাটরা একদিন হারিয়ে যাবে।”

ছোট কাটরার সামনের ফটকে ঢুকলেই চোখে পড়ে একটি সাবান কারখানা। পেছনের ফটকের সামনে রয়েছে একটি আটা তৈরির কারখানা। ভবনের বিভিন্ন চেম্বারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এসব কারখানার কাঁচামাল।

বড় কাটরার প্রায় পুরোটা জুড়েই একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন সময় ভবনের ভেতরে সংস্কার চালিয়েছে।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, মুঘল সম্রাট শাজাহানের ছেলে শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪১ সালে নির্মিত হয় বড় কাটরা। আর মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খান আনুমানিক ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালে নির্মাণ করেন ছোট কাটরা। এ দুটোই সে সময়ে ব্যবহার করা হতো সরাইখানা হিসেবে।  

ইংরেজ শাসনামলে ১৮১৬ সালে মিশনারি লিওনার্দ ছোট কাটরায় খুলেছিলেন ঢাকার প্রথম ইংরাজি স্কুল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় কাটরা ও ছোট কাটরা তৎকালীন ঢাকা নগরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছিল। দুটি স্থাপনাই সেক্যুলার স্থাপত্য। এ-ধরনের সেক্যুলার স্থাপত্যের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।”

প্রাচীন কালের এ ধরনের বহু স্থাপনা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় এই স্থাপনা দুটো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

স্বাধীন সেনের পরামর্শ, সবার আগে স্থাপনা দুটি ও তার চারপাশ থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। এরপর আইন অনুযায়ী সংস্কার করে এর সংরক্ষণ করতে হবে।

বড় কাটরা ও ছোট কাটরা নিয়ে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরও রাজউককে দোষ দিচ্ছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আতাউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোট কাটরার সামনে যে কন্ট্রাকশন হচ্ছে সেই ভবনের মালিককে আমরা নিজেরাই গিয়ে মানা করেছি, কিন্তু তিনি লোকাল হওয়ায় আমাদের পাত্তাই দিচ্ছেন না।

“ভবনের মালিক বলছেন, তার কাছে রাজউকের অনুমোদন রয়েছে। রাজউক কেন অনুমোদন দিল, এটা আমার জানার কথা না। আমরা থানায় বিষয়টি জানিয়েছি, দেখা যাক কী হয়।”

বড় কাটরা এবং ছোট কাটরা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা এ দুটি স্থাপনা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চালাচ্ছি। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটা একটু জটিল, তাই হুট করেই করা যায় না।”

এজন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে বলে জানান আতাউর রহমান।

বড় কাটরা ও ছোট কাটরা নিয়ে রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) আব্দুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-১ আমিনুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

ড্যাপে কেন বড় কাটরা ও ছোট কাটরা চিহ্নিত নয়- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় আমিনুর রহমান কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

তবে সেখানে ভবন নির্মাণ বন্ধে রাজউক তৎপর বলে দাবি করেন তিনি।

কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার আড়াইশ’ মিটারের মধ্যে কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজউকের একটি বিশেষ কমিটির ছাড়পত্র নিতে হয়। এছাড়াও ভবনের নকশারও অনুমোদন নিতে হয়।

এক্ষেত্রে ওই ভবন মালিক বিশেষ কমিটির ছাড়পত্র পেলেও নকশার অনুমোদন এখনো দেওয়া হয়নি বলে জানান আতাউর রহমান।

“আমরা ইতোমধ্যে পুলিশের সহযোগিতায় ছোট কাটরার সামনে ভবনটির নির্মাণ কাজ বন্ধ করেছি।”