আশরাফুজ্জামানের সেই ডায়েরি ট্রাইব্যুনালে

পত্রিকায় প্রকাশিত তালিকার ছবি দেখে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা সম্বলিত ‘ঘাতক’ আশরাফুজ্জামান খানের ডায়েরি সনাক্ত করেছেন এক সাক্ষী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Sept 2013, 05:44 PM
Updated : 5 Sept 2013, 06:40 PM

মুক্তিযুদ্ধের পরে ‘জল্লাদের ডায়েরি’ শিরোনামে বুদ্ধিজীবীদের যে তালিকা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, তা তাদের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা ডায়েরির অংশ বলে আদালতকে নিশ্চিত করেন প্রসিকিউশনের ২১তম সাক্ষী আলী সাজ্জাদ।

ওই ডায়েরিতেই অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার ও সেলিনা পারভীনসহ আরো বুদ্ধিজীবীর নামের তালিকা পাওয়া গিয়েছিল, যাদের ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

সাজ্জাদ ট্রাইব্যুনালকে জানান, তার বাবা শেখ মোহাম্মদ আলী তেজগাওঁয়ে ৩৫০ পূর্ব নাখালপাড়ার বাড়ির মালিক ছিলেন। ওই বাড়ির কয়েকটি টিনশেড ঘরের একটিতে পরিবারসহ ভাড়া থাকতেন আশরাফুজ্জামান খানের বড় ভাই রওশন আলী খান। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশরাফুজ্জামান ভাইয়ের বাসায় থাকতেন।

ওই বাসা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবীদের তালিকাসম্বলিত আশরাফুজ্জামানের ডায়েরিটি উদ্ধার করা হয় বলে জানান তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগ মুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও শাহিনুল ইসলামের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন তিনি।

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সঙ্গে ১৯ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকাসম্বলিত ওই ডায়েরির দুটি পৃষ্ঠার ছবি ছাপা হয়।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাহীদুর রহমান ওই পৃষ্ঠাদুটির একটি অনুলিপি সাক্ষীর সামনে উপস্থাপন করলে তা তাদের বাড়ি থেকে সেদিনের উদ্ধার করা ওই ডায়েরির অংশ বলে নিশ্চিত করেন সাজ্জাদ।

তিনি জানান, বিজয় দিবসের ৬/৭ দিন পর সাদা পোশাকের পুলিশ এসে তার বাবাকে ডেকে আশরাফুজ্জামানের ঘর তল্লাশির অনুমতি চায়। তার বাবা ও তিনি পুলিশের সঙ্গে ওই ঘরে তালা ভেঙ্গে প্রবেশ করেন।

এই সাক্ষী বলেন, “ঘণ্টখানেক তল্লাশির পর পুলিশ বিভিন্ন বই-পত্র একটি ডায়েরি উদ্ধারের পর একটি জব্দ তালিকা তৈরি করে। ওই সময় একটি ডায়েরি আমার বাবাকে দেখিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বলে, ‘দেখেন, তারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য এই তালিকা তৈরি করেছে। আপনার বাসায় বসেই এটা করা হয়েছে।’
“পরবর্তীতে পত্রিকায় ওই ডায়েরি সম্পর্কে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন, এই দ্যাখ এটা সেই ডায়েরি, যা আমাদের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।”
৫৫ বছর বয়সী কানাডাপ্রবাসী এই সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তেজাগাঁও পলিটেকনিক স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।

তিনি জানান, তাদের বাড়ীতে বাঁশের বেড়াবেষ্টিত আলাদা আলাদ নয়টি টিন শেডের ঘর ছিল। দুই কক্ষের ঘরগুলোর একটিতে পরিবারসহ ভাড়া থাকতেন আশরাফুজ্জামানের বড় ভাই।

সাজ্জাদ জানান, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা পুরো পরিবার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুন বা জুলাই মাসে ঢাকায় ফিরে আসেন তারা।

তিনি বলেন, “ফিরে এসে দেখি আমাদের ৯ ভাড়াটিয়ার মধ্যে একটি ছাড়া (রওশন আলী খানের বাসা) প্রত্যেকের ঘর তালাবদ্ধ। সেই ঘরটিতে আশরাফুজ্জামান খান তার কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাঝে মাঝে থাকতেন। তার ভাই রওশন আলী খান ও তার পরিবার ওইসময় বাসায় থাকতেন না।”

হাসান নামে তার এক দূর সম্পর্কের এক মামাকে (বর্তমানে মৃত) মাঝে মধ্যে আশরাফুজ্জামান খানের সঙ্গে ওই ভাড়া বাসায় আসতো বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “আমি যখন হাসান মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কেন আমাদের বাড়ীতে আসো না? তার উত্তরে মামা বললো, আমরা এখন ছাত্রসংঘের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। তুমি ছোট মানুষ, তুমি বুঝবে না। এখন তোমাদের বাসায় যাওয়ার সময় নাই।”

তিনি আরো জানান, ওই ঘরের বাসিন্দারা পরে আর কখনো ফিরে আসেনি।

সাক্ষ্য শেষ হলে আলী সাজ্জাদকে জেরা করেন আশরাজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান।

জেরা শেষে সোমবার এ মামলার পরবর্তী সাক্ষগ্রহণের দিন ঠিক করে ট্রাইব্যুনাল।

চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত ২৪ জুন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন হয়।

গত ২ মে দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল ট্রাইব্যুনাল। দেশে না পাওয়ায় তাদের হাজির হতে দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশও হয়েছিল।

বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।