বাবা-মা হত্যাকাণ্ডে ঐশী জড়িত: পুলিশ

এসবি কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম হত্যাকাণ্ডে তাদের মেয়ের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2013, 12:47 PM
Updated : 18 August 2013, 03:51 AM

শনিবার তাদের মেয়ে ঐশী নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেয়ার পর তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে আটকের পর পুলিশের এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর খোয়া যাওয়া কিছু গহনাও ঐশীর কাছে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম।

এদিকে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মাহফুজের ভাই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি মামলা করেছেন। মাহফুজ ও স্বপ্নার লাশের ময়না তদন্ত হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে।

ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাহফুজ ও স্বপ্নাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে এবং খুনি ছিলেন দুইয়ের বেশি এবং তারা অপেশাদার। 

শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার চামেলীবাগের একটি ভবনের ফ্ল্যাটে মাহফুজ ও স্বপ্নার ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। দুই সন্তান ঐশী ও ঐহী এবং শিশু গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন তারা।

অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ও লেভেলের ছাত্রী বৃহস্পতিবার সকালে তার সাত বছর বয়সী ছোট ভাই ঐহী ও গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বলে ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক জানান। তারপর থেকে ঐশীর খোঁজ মিলছিল না।

ঐহী ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলে পুলিশের সন্দেহ হয়, ঐশীকে জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকাণ্ডের কূল-কিনারা করা যাবে।

নিহত স্বপ্না বেগম ও তার স্বামী মাহফুজুর রহমান

শনিবার দুপুরে ঐশী নিজেই পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এরপর তাকে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ অভিযানে নামে।

সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন, ঐশী, তার বন্ধু রনি ওরফে জনি এবং গৃহকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া আরো তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এনেছেন তারা।

বাড়ি থেকে খোয়া যাওয়া কিছু অলঙ্কার ঐশীর কাছে পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে যে তথ্য আমরা পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে ঐশী এই হত্যাকাণ্ডে কিছুটা জড়িত।”

পাঁচ তলা ওই ভবনের কর্মীরা জানায়, ঐশী বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিল।

হত্যাকাণ্ড সংঘটনের আগে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রীকে ঘুমের ওষুধ জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়েছিল বলে ধারণা করছে পুলিশ।

কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে- জানতে চাইলে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, তারা এখনো তা নিশ্চিত হন। অনুসন্ধান চালাচ্ছেন।

এসবির উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, ঐশীর বাড়ি থেকে একা বের হতে তার বাবা-মার বারণ ছিল। খালুর বাসায় যাওয়ার কথা ভবনের তত্ত্বাবধায়ককে জানিয়ে শুক্রবার ভাই ও গৃহকর্মীকে নিয়ে ঐশী বাসা থেকে বের হয়। শুক্রবার সকালে একটি রিকশায় করে ঐহীকে ওই ভবনের এক প্রতিবেশীর বাসায় ফেরত পাঠানো হয়।

ঐশীর মামা রবিউল ইসলাম বলেন, শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে ঐশী ফোন করে তাকে বাসায় আসতে অনুরোধ করে।

“ও বলে, মামা আমরা বাসার বাইরে ছিলাম। এখন বাসায় যাচ্ছি, তুমি আসো।”

রবিউল জানান, তিনি বাসায় এসে ঐশীদের ফ্ল্যাট তালাবদ্ধ দেখেন। ঘণ্টাখানেক পর বেলা ১১টার দিকে ঐহী বাসায় আসে। তখন বোন-দুলাভাইয়ের ফোনে অনেকবার কল করে সেগুলো বন্ধ পাওয়ার পর পুলিশে খবর দেন।

তখন পর্যন্ত ঐশীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ‘পলাতক’ ঐশী শনিবার দুপুরে পল্টন থানায় যান।

তখন কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, থানায় এসে ঐশী ডিউটি অফিসারের কাছে গিয়ে তার পরিচয় দেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ওসির কক্ষে নেয়া হয়।

“ওসি এরপর তাকে নিয়ে যান কাছেই মতিঝিল জোনের উপকমিশনারের অফিসে।”

সেখান থেকে ঐশীকে নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে। এরপর তাকে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল অভিযানে নামে।

‘খুনিরা অপেশাদার’

অপেশাদার ব্যক্তিদের ছুরির আঘাতে পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজ ও তার স্ত্রী স্বপ্না নিহত হয়েছেন বলে ময়না তদন্তে উঠে এসেছে।

এই হত্যাকাণ্ডে একাধিক ব্যক্তি জড়িত ছিলেন বলে ধারণা করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ।

ময়না তদন্তে দেখা গেছে, নিহত পুলিশ কর্মকর্তার দেহে ছুরিকাঘাতের দুটি এবং তার স্ত্রীর দেহে ১১টি চিহ্ন রয়েছে।

শনিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল মর্গে মাহফুজ ও স্বপ্নার ময়না তদন্ত হয়।

ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুজনের শরীরে ছুরিকাঘাতের১৩টি চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাহফুজের শরীরে দুটি এবং তার স্ত্রীর শরীরে ১১টি।

“পুলিশ পরিদর্শককে ছুরি মারা হয় গলায়, এতে শ্বাস নালী কেটে মৃত্যু হয় তার।”

রাজধানীর চামেলীবাগের একটি বাসা থেকে শুক্রবার এক পুলিশ পরিদর্শক ও তার স্ত্রীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধারের পর গোয়েন্দা পুলিশের তল্লাশি। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

স্বপ্না বেগমের গলায় দুটি, ডান পাঁজরে তিনটি, বুকে একটি এবং পেটে ও পিঠেও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এতে তার লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শ্বাসনালী কেটে যায়।

এটি ছুরিকাঘাত, না কি কোপের চিহ্ন- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে ডা. সোহেল বলেন, “অল আর স্ট্যাব, নট চপিং।”

হত্যাকাণ্ডের পর ওই বাসা থেকে একটি বটি ও একটি ছুরি জব্দ করে পুলিশ।

ডা. সোহেল বলেন, “কমপক্ষে দুই থেকে ততোধিক ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

“এতগুলো স্ট্যাব করা হয়েছে, তাতে মনে হয় অপেশাদার কেউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।”

এসবির উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া শুক্রবার বলেছিলেন, “আক্রোশ থেকে পরিকল্পিতভাবে দুজনকে খুন করা হয়েছে। চার থেকে পাঁচ জন এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।”

যে ছুরি দিয়ে মারা হয়েছে তার দুপাশই বেশ ধারাল ছিল বলেও জানান সোহেল মাহমুদ। 

মৃত্যুর আগে তাদের কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি না, তা জানতে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য শরীরে বিভিন্ন অংশের নমুনা রাখা হয়েছে।