গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধীদের হোতা গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৯০ বছর দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2013, 09:32 AM
Updated : 12 August 2013, 10:38 AM

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন দলের সমন্বয়ক এম কে রহমান সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এই আপিলের সঙ্গে একাত্তরে ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার আবেদনও জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।

গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় বিভিন্ন দল ও সংগঠন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিল।

অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য হলেও বয়স ও স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনায় গত ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর রায়ে বলেন, “তার যে  অপরাধ, এর সবগুলোই সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তবে গ্রেপ্তারের পর থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ভর্তি আছেন। তার বয়স ও শরীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এই সাজা দেয়া হয়েছে।”

রায়ের পর্যবেক্ষণে গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের সাবেক আমির গত ৫ অগাস্ট আপিল করেন।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে দমনের জন্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শান্তি বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী গঠন এবং সেগুলোর কার্যক্রম পরিচালনায় সভা করেন। এ দুটি অভিযোগে প্রতিটিতে তাকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

তৃতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানি দেয়ার ২৮টি ঘটনার কথা বলা হয়। চতুর্থ অভিযোগে ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা। এ দুটি অভিযোগের প্রতিটির জন্য তাকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটির যুদ্ধকালীন প্রধানের বিরুদ্ধে পঞ্চম অভিযোগ ছিল পুলিশ কর্মকর্তা সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ দেয়, যার জন্য তাকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

প্রতিটি অপরাধের সাজা একের পর এক কার্যকর হবে বলেও ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলা হয়েছে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান এই জামায়াত নেতা।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা; নাগরিকত্বও ফিরে পান। ১৯৯৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলেও দলটির তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন।

গোলাম আযম ফেরার পর থেকেই একাত্তরের ভূমিকার জন্য তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণ আদালতে প্রতীকী বিচার ও ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি চূড়ান্ত রূপ পায়।

সে সময় ক্ষমতাসীন সরকার সেই দাবিতে সাড়া না দিলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠনের মধ্য দিয়ে বহু প্রতীক্ষিত সেই বিচার কাজ শুরু হয়।

২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এর ভিত্তিতে ওই বছর ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ২০১২ সালের ১১ই জানুয়ারি গোলাম আযমকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠান। তখন থেকেই তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখা হয়েছে।

এরপর পাঁচ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬১টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে গত বছরের ১৩ মে জামায়াতের এই সাবেক আমিরের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হলেও গোলাম আযমের পক্ষে সাক্ষ্য দেন কেবল তার ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।