পরীক্ষা পদ্ধতিরও সংস্কার দরকার: সা’দত হুসাইন

.বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2013, 04:59 AM
Updated : 27 July 2013, 06:32 AM

৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফলকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি নতুন করে আলোচনা ওঠে কোটা নিয়ে। উত্তীর্ণ না হতে পারা একদল নামে আন্দোলনে, দাবি তোলে মুক্তিযোদ্ধাসহ সব কোটা বাতিলের। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য কোটা রাখার দাবি নিয়ে মাঠে নামে আরেক দল।

আলোচিত এই বিষয় নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কথা বলেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান সা’দাত হুসাইনের সঙ্গে। খোলামেলা আলোচনায় অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব বলেছেন, কোটা পদ্ধতি বাতিল না করে এর সংস্কার করতে হবে, সেই সঙ্গে বদলাতে হবে পরীক্ষা পদ্ধতিও।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফয়জুল সিদ্দিকী। তার সঙ্গে ছিলেন আলোকচিত্রী আসাদুজ্জামান প্রামানিক

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: বাংলাদেশের কোটা পদ্ধতি সম্বন্ধে আপনার মুল্যায়ন কী? এ পুরো ব্যবস্থাটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

সা’দাত হুসাইন: কোটার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, তারপরও এটি একটি জাতীয় ইস্যু। এর জটিলতা এমন একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে এর সমাধান দুরূহ হয়ে পড়েছে।

দেখুন, প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী, ক্যাডার-নন ক্যাডার, সব জায়গায় কোটার ব্যবহার রয়েছে। একেকটা কোটা একেক ধরনের। আকবর আলি খান (সাবেক সচিব) গবেষণা করে বলেছেন, দেশে ২৫৭ ধরনের কোটা রয়েছে।

তাই কোটার একটি বা দুটি শাখা নিয়ে সমাধান বের করলে হবে না। কোটা নিয়ে কাজ করতে হলে সব জায়গায় হাত দিতে হবে। ২০০৯ এর বাৎসরিক প্রতিবেদনে বলেছিলাম, কোটা এমন এক পর্যায়ে গেছে যে সেটা কোনো মানবীয় গুণাবলি দ্বারা সমাধান করা সম্ভব না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: সরকারি চাকরিতে ৫৬ ভাগ কোটার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু ২৭ থেকে ৩০তম বিসিএসে দেখা যায়, কোটায় বরাদ্দকৃত অনেক পদ খালি ছিল। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

সা’দাত হুসাইন: কোটা বলতে শুধু বিসিএস এর কোটা বোঝালে হবে না। সবাই শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটার কথা বলছে। নারী কোটা, জেলা কোটা, আদিবাসী কোটা আছে। প্রত্যেক কোটায়ও ভাগ আছে।

আর কেউ কখনো কোটা পেলে তা ছাড়ে? আমাদের সংসদের কোটা কি খালি আছে?

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনি জেলা কোটার কথা বলছেন, কিন্তু দেশে অনেক জেলা রয়েছে কোটা ব্যবস্থায় যেগুলো স্থান পায় না। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

সা’দত হুসাইন: জনসংখ্যার ভিত্তিতে এ পদ্ধতি চালু থাকায় ছোট জেলাগুলো কোনো কোটাই পায় না। ফলে যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, তা বিপরীত হয়ে গেছে। মেহেরপুর, লালমনিরহাট, শেরপুর, লক্ষ্মীপুর এরকম জেলাগুলো কোনো কোটা পায় না।

আমরা যেটা করেছিলাম, যদি ১৮৯টি পদ থাকে, তাহলে প্রত্যেক জেলাকে কমপক্ষে একটা করে পদ দিতে হবে। আর যদি ১৮টির বেশি পদ হয়, তাহলে প্রত্যেক বিভাগকে একটা করে পদ দিতে হবে। আমরা দেশের ৩১টি উপজেলাকে অনগ্রসর অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে ২% কোটা রেখে নিয়োগ দিয়েছিলাম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: সেক্ষেত্রে আপনার মতে, কোটার বিন্যাস কেমন হওয়া উচিত?

সা’দাত হুসাইন: এগুলো নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক না। বিসিএস ক্যাডার হওয়া সবার টার্গেট। এর মাধ্যমে যারা কর্মকর্তা হবে, তারাই তো একদিন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থাকবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানের ভূমিকায় থাকবে। কাজেই বিসিএসের জন্য আলাদা কোটা পদ্ধতি চালু করতে হবে। যেখানে মেধার মূল্যায়ন বেশি হবে।

গেজেটেড অফিসার ছাড়া নন-ক্যাডারে প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির হাজার হাজার পোস্ট আছে, সেখানে আরেক ধরনের কোটা পদ্ধতি চালু করতে হবে।

তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে যারা চাকরি করবে তারা তো দেশের নীতি নির্ধারণী হবে না, তাদের জন্য আরেক ধরনের কোটা চালু করতে হবে। এসব জায়গায় তো মেধার দরকার নাই। সেখানে কোটা বাড়িয়ে দেয়া হোক। পিয়ন পোস্টে ভুরি ভুরি কোটা হোক। এখানে আঞ্চলিক কোটা বাড়িয়ে দেয়া হোক, ক্যাডারে কোটা কমিয়ে আনা হোক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: কিছুদিন আগে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পিএসসি বিসিএস প্রাক বাছাই পরীক্ষার ফলাফল সংস্কারও করছে। পুরো বিষয়টি সম্বন্ধে আপনার মতামত কী?

সা’দাত হুসাইন: কোটা মানেই হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার মানুষকে সুযোগ দেয়া। এজন্য কোটা থাকতে হবে। তবে কোটা সংস্কার মানে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কার নয়। সব কোটার সংস্কার করতে হবে।

আর কোটা তো পরীক্ষার সঙ্গে মিশে গেছে। যেহেতু পরীক্ষা হচ্ছে সব ক্যাডারে। প্রত্যেকটা সাব ক্যাডারে এক একটা কোটা। অতএব পরীক্ষা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।

এর সংস্কার উচ্চ পর্যায়ের বিষয়। তাদেরকে আলোচনা করতে হবে। আলোচনা হলে অনেক কিছু বের হয়ে আসে। সংসদ সদস্যদের হাতে প্রচুর সময় আছে। কাজেই সংসদে এ বিষয়ে আলোচনা করে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনি কোটা ও পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের কখা বলছেন, পুরো প্রক্রিয়াটা কিভাবে করা উচিত বলে আপনার মনে হয়?

সা’দত হুসাইন:  শুধু সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল এটার সমাধান দিলে হবে না। সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটা সমাধানে আসতে হবে। কোটার একগুচ্ছ চালক আছে। সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। এক সাইড দেখলে অন্য সাইডে প্রবলেম দেখা দেবে। মাথার মধ্যে বিসিএস ঢুকালে হবে না, অন্য অংশ নিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যথায় বহু জটিলতার কোটায় নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হবে।

আপাতত কয়েক বছরের জন্য একটা সমাধান বের করে আনতে হবে যেটাতে সবাই মিলে সাসটেইন করতে পারবে। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: পৃথিবীর অনেক দেশেই তো কোটা পদ্ধতি রয়েছে। সেসব দেশে কোটা কার্যকরের ধরন কী রকম?  

সা’দত হুসাইন:  দেখুন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই কোটা আছে। তবে তা অন্য ভাবে। যুক্তরাষ্ট্রে কোটাধারীদের আগেই একটা নম্বর দেয়া হয়। এরপর ওপেন পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

আর ভারত তো কোটাকে একটা সুন্দর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সেখানে কোটা আছে, তবে তা উপার্জনের ভিত্তিতে। উচ্চ আয়ের মানুষরা কোটা পায় না। এক্ষেত্রে তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকেও ছাড় দেয় না। এবং একবার যে কোটার সুবিধা পাবে, সে কখনো আর কোটার সুবিধা পাবে না।

ধরুন, বাবা যদি কোটা সুবিধা পায় তার সন্তানেরা কোনো কোটা সুবিধা পাবে না। কেউ যদি কোটা দিয়ে কলেজে ভর্তি হয়, তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ (কোটা সুবিধা) পাবে না। আর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটায় ভর্তি হয়েছে, সে কখনো চাকরিতে কোটা সুবিধা পাবে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:
আপনি পিএসসির চেয়ারম্যান থাকাকালীন কোটা নিয়ে একটা কমিটি করেছিলেন। তার বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে কিছু জানেন কি?

সা’দত হুসাইন:  কোটা নিয়ে আমরা একটি মৌলিক গবেষণা করেছি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলব না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান এবং বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার ওপর ২০০৮ সালের মার্চে একটি গবেষণা করেছেন। ৬১ পৃষ্ঠার ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি পিএসসিতে আছে। তাদের গবেষণাটি বিশ্বমানের।

এই গবেষণায় দেখা গেছে, কোটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জরুরি। তবে এর পরিমাণ ও প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। যেমন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা। মেধা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যন্ত ডাকা হলো। কিন্তু পঞ্চম পর্যন্ত গিয়ে আটকে যেতে হল। তখন টেকনিক্যাল ক্যাডার যিনি দেখছেন তিনি হাত উঁচিয়ে বলছেন, জেলা কোটা দিয়ে এটি পূরণ হয়ে গেছে। এটি একটি সমস্যা বলে মনে করি।

প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা, এরপর নারী এবং সর্বশেষ উপজাতি কোটা সংরক্ষণ করা আছে। এখন সম্ভবত যে একাধিক কোটার যোগ্যতা রাখে তাকেই আগে বিবেচনা করা হয়। যেমন, কোনো উপজাতি নারী যদি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়, তাহলে তাকে আগে বিবেচনা করতে হবে। ফলে এই বিবেচনায় দেখা গেল, ভালো করার পরেও রাঙামাটিতে জেলা বা নারী কোটায় আর সুযোগ থাকল না। আমি মনে করি, এখানে অনিয়ম দুর্নীতি করার সুযোগ থেকে যায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: তাহলে আপনি বলছেন যে দেশে কোটা পদ্ধতির একটা আমূল পরিবর্তন দরকার।

সা’দাত হুসাইন: অবশ্যই, এবং যে একবার কোটার সুবিধা ভোগ করবে তার কিংবা উত্তরসূরিদের আর দ্বিতীয়বার ভোগ করার সুযোগ বন্ধ করতে হবে।

ধরুন, আমি অনগ্রসর অঞ্চলের কোটার সুবিধা পেয়েছি। আমি তো এ সুবিধা ভোগ করেছি আমার সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান তৈরির জন্য। আমার পরিবার-সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। কাজেই তারা আর কোটার সুবিধা পাবে না।

একইভাবে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী এবং নারী কোটার ক্ষেত্রেও যারা একবার কোটা সুবিধা পাবে তাদেরকে দ্বিতীয় বার এ সুবিধা না দেয়ার নিয়ম করতে হবে। তাহলেই কোটার সুফল আসবে।