জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলে কাজ করুন: ডিসিদের প্রধানমন্ত্রী

দেশে যেন আর অসাংবিধানিক সরকার না আসতে পারে সেজন্য সতর্ক থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার জন্য জেলা প্রশাসকদের আরো মনোযোগী হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2013, 06:49 AM
Updated : 23 July 2013, 07:14 PM

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে চলতি বছরের জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধন করে তিনি বলেন, “আর যেন দেশে কোনো অসাংবিধানিক শাসক না আসতে পারে সেজন্য মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে।”

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। পরে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা সম্মেলন কক্ষে তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশন শুরু হয়।

সরকারের মেয়াদের শেষ বছরের এই সম্মেলনে ২৪২টি প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকরা সরকারের কাছে এসব প্রস্তাব করেছেন।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭টি বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

তিনি বলেন, “আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মিলিটারি, কোজি মিলিটারি এবং মিলিটারি ব্যাকড সরকারের জাঁতাকলে মানুষ নিষ্পেষিত হয়েছে।”

অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে অনুষ্ঠানে আবারো উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

“আমাদের এক জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। আমাদের দেশে কখনোই ক্ষমতার হস্তান্তর সুষ্ঠু হয়নি। পঁচাত্তরে হত্যা-ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল শুরু হলো। তারপর, এভাবেই চললো। ২০০১ সালেই কেবল শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে।”

বর্তমান সরকারের সময়ে জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার পর্যায়ে পাঁচ হাজার ৬৪৪টি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আমরা কোনো নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করিনি। জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জনগণ ভুল করতে পারে। বিভ্রান্ত হতে পারে। কাকে ভোট দিতে হবে- তা দিতে দিতে শিখবে।

“আমরা আর পেছনে ফিরে যেতে চাই না। জনগণ ভোট দিলে আছি। না হলে নাই।”

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কীভাবে নির্বাচন হয় তা দেখতেও জেলা প্রশাসকদের প্রতি আহবান জানান তিনি।

জেলা প্রশাসকদের ত্যাগ ও সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধনমন্ত্রী বলেন, “জেলা প্রশাসক হিসেবে আপনাদের বহুবিধ জনকল্যাণমুখী কাজের মধ্যে কিছু বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্য আমি আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

এই ১৭টি বিষয়ের মধ্যে তৃণমূলে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা; সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষের হয়রানি বন্ধ; নারী ও শিশু নির্যাতন ও পাচার, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, যৌতুক, ইভটিজিং ও বাল্যবিবাহের মতো ‘সামাজিক ব্যাধির’ বিস্তার রোধ; প্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণ; জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া শিক্ষার সব স্তরে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করা; প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার ও মানোন্নয়ন; পণ্যের চাহিদা, মজুদ ও সরবরাহ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ; রোজায় পণ্য সরবরাহে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির চেষ্টা কঠোরভাবে দমন; ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি; কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ; খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ; স্থানীয় সম্পদ এবং সম্ভাবনার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি; প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সমবায়ে উৎসাহিত করা; পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি; দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে নির্দেশনা অনুসরণ এবং সাধারণ মানুষের সুবিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিতে গ্রাম আদালতকে কার্যকর করার বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।

বর্তমান সরকারের সময়ে জেলা প্রশাসকরা সুষ্ঠুভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনারা এই চার বছর কর্মক্ষেত্রে যতোটা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্বপালন করতে পেরেছেন- অতীতে তা পারেন নাই।”

মসজিদ ও মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে কেউ যাতে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য জেলা প্রশাসকদের সচেতনতা সৃষ্টি করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়া সব জেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, “এ সম্মেলনে প্রতি বছর কেন্দ্রের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সরাসরি মতবিনিময়ের যে সুযোগ সৃষ্টি হয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমস্যাগুলো এবং সেগুলো থেকে উত্তরণের পন্থা ও কৌশল নির্ধারণে এ সম্মেলনে আলাপ-আলোচনা হয়।”

তিনি বলেন, “এটা আমাদের মেয়াদকালের শেষ সম্মেলন। সামনের নির্বাচনে জনগণ যাকে ভোট দেবে সেই পরবর্তী সম্মেলন করবে। জনগণ আমাদের ভোট দিলে আবার দেখা হবে।”

জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি আধুনিক, জ্ঞানভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সরকার গত সাড়ে চার বছরে কঠোর পরিশ্রম করেছে।

“অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অর্জন করেছি অভূতপূর্ব সাফল্য। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, আগামী নির্বাচনের আগেই সরকারের অবশিষ্ট অঙ্গীকারসমূহও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।”

ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধের ছয়টি মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাকি রায় পাব। এই রায় ইনশাল্লাহ বাস্তবায়ন হবে। আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।”

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকার ‘উল্লেখযোগ্য সাফল্য’ অর্জন করেছে দাবি করে এজন্য জেলা প্রশাসকদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আপনাদের নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।”

অর্থনীতি ও কৃষিখাতে সরকারের উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, কৃষকদের পণ্যের  ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে।

“দেশব্যাপী আমরা উন্নয়ন ছড়িয়ে দিতে চাই। সে দিকে লক্ষ্য রেখেই আপনারা কাজ করবেন।… উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।”

বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড রিজার্ভের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। অন্যের কথা শুনব? অন্যের মুখ ঝামটা শুনব? আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। অন্যের শর্ত কোনো শুনব?” 

নবায়ণযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে জনসচেতনতা সৃষ্টি, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, বাজেট বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা এবং জেলা স্কুলগুলোর মানোন্নয়নে জেলা প্রশাসকদের আরো উদ্যোগী হতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।

ক্ষমতা বিকেন্দ্রিকরণের ইচ্ছার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এবার পারলাম না। আগামীতে এলে জেলা ও উপজেলার ক্ষমতা নির্দিষ্ট করব। জেলা ও উপজেলার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করব।”

প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমামও অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। স্বাগত বক্তব্য দেন, মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।

বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষ থেকে ঢাকার এ এন শামসুদ্দিন আজাদ চৌধুরী এবং জেলা প্রশাসকদের পক্ষে ভোলার খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান, যশোরের মোস্তাফিজুর রহমান ও কুমিল্লার তোফাজ্জল হোসেন মিয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে  বক্তব্য দেন। 

এছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।