বুদ্ধিজীবী ও হিন্দু হত্যাযজ্ঞের দায়ে ফাঁসি

জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে একাত্তরে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যাসহ মানবতাবিরোধী পাঁচটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবও কাজী শাহরীন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2013, 11:59 PM
Updated : 17 July 2013, 04:44 AM

এর মধ্যে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হত্যা-নিযার্তনের দায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদণ্ড কাযর্কর করতে বলেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণকে দমাতে গঠিত আলবদর বাহিনীর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে মুজাহিদই যে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাও উঠে এসেছে এই রায়ে।

তবে দুটি অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলেও তাতে এই জামায়াত নেতার সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বুধবার বেলা ১১টা ৫ এ জনাকীর্ণ আদালতে ২০৯ পৃষ্ঠার রায়ের ভূমিকা পড়া শুরু করেন।

এরপর আসামি মুজাহিদের উপস্থিতিতে রায়ের ৩৭ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসারের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম। অপর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া পড়েন দ্বিতীয় অংশ।

বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম বলেন, মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে গঠিত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ওই বাহিনীর ওপর তার ‘কার্যকর নিয়ন্ত্রণ’ থাকার বিষয়টিও প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।  

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন মাস ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান হিসাবে আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বেই এ বাহিনী বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়। 

মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ১, ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে  রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক। তাবে ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়নি। 

কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়ার পথে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ

ফাঁসির রায়ের পর ট্রাইব্যুনাল থেকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে মুজাহিদকে

মৃত্যুদণ্ড

মামলার প্রথম অভিযোগে বলা হয়, পাকিস্তানের বাঙালি সহযোগীদের বিরুদ্ধে একটি দৈনিকে প্রবন্ধ লেখার অপরাধে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগের বাসা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয় ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। পরে তাকে হত্যা করা হয়।

ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে, যেখানে পরে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হতো ওই ক্যাম্প। পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা মুজাহিদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল সেখানে। ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রও করতেন তিনি। এ ধরনের ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ গণহত্যার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়।

আর প্রসিকিউশনের সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেন সাহা, শানু সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলাধর মিত্র, সত্য রঞ্জন দাশ, নরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করে। পরে উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকার বিনিময়ে স্বামীর মুক্তি চাইলেও মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকাররা সবাইকেই হত্যা করে। একই সময়ে রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝর্ণা রানীকে ধর্ষণ করে। হিন্দুদের বসতঘরে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া অনিল সাহা নামে একজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।

এই তিন অভিযোগের মধ্যে প্রথমটিকেও বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে যুক্ত করে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। এই আদেশ হয়েছে সপ্তম অভিযোগেও।

যাবজ্জীবন

পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যাদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়।

৩০ অগাস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানসিক নির্যাতনের পর জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করে।

ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় মুজাহিদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

পাঁচ বছর জেল 

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট (রথখোলার) এলাকার মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের ছেলে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউসে মুজাহিদের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়।

সেখানে নির্যাতনের পর মুজাহিদের নির্দেশে তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আব্দুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে বাবু নাথ সেদিন জানালার শিক ভেঙে পালিয়ে জীবন বাঁচান বলে ট্রাইব্যুনালে দেয়া সাক্ষ্যে জানান।

অপহরণের এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় মুজাহিদকে। 

দুই অভিযোগে খালাস

প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানায় বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গি গ্রামে হিন্দুদের প্রায় সাড়ে তিনশ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা। হামলাকারীদের গুলিতে ৫০ থেকে ৬০ জন নরনারী নিহত হন। ওই ঘটনায় ফরিদপুর শহরের হামিদ মাওলানা ছাড়াও ৮/১০ জন অবাঙালি অংশ নেন।

আর চতুর্থ অভিযোগ অনুযায়ী, একাত্তরের ২৬ জুলাই আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখে। সেখানে মুজাহিদের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে জানতে পেরে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। প্রায় এক মাস ৩ দিন নির্যাতনে পাখির বুক ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।

রায়ে বলা হয়, এ দুটি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও ঘটনায় মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে পারেনি প্রসিকিউশন।

আর দুটি অভিযোগে কারাদণ্ডের কথা বলা হলেও বাকিগুলোতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হওয়ায় ‘ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ মুজাহিদের সাজা কার্যকর করতে বলেছেন বিচারক।

২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তারের পর গত বছর ২১ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৭ জন সাক্ষ্য দেন। অন্যদিকে মুজাহিদের পক্ষে সাক্ষ্য দেন কেবল তার ছোট ছেলে আলী আহমাদ মাবরুর।