গোলাম আযমের বাকি জীবন কারাগারেই

৯১ বছর বয়সে ৯০ বছর কারাদণ্ড হওয়ায় কার্যত বাকি জীবন কারাগারেই থাকতে হচ্ছে গোলাম আযমকে।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবমুনীরুল ইসলাম ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2013, 05:41 AM
Updated : 15 July 2013, 05:52 AM

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের যাবতীয় অভিযোগ ‘ডাঁহা মিথ্যা’ বলে দাবি করে এলেও এই বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের সবকটিরই প্রমাণ পেয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযমের অপরাধের সাজা মৃত্যুদণ্ড বলে আদালত মনে করেছে, তবে বয়স বিবেচনায় তাকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

ফলে ১৯২২ সালে জন্ম নেয়া গোলাম আযমকে বাংলাদেশের কারাগারেই শেষ জীবনটি থাকতে হচ্ছে, যে দেশটির স্বাধীনতার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।

শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে এবং তার দালিলিক প্রমাণও রয়েছে বলে জানিয়েছেন লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।

তবে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ- একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দমনে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের ছকটি ছিল তারই আঁকা।

গোলাম আযমের দাবি, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ‘না পারা’ রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে জুলুম থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন।

তবে প্রসিকিউটার তুরীন আফরোজের ভাষায়, বাতিঘর যেভাবে সমুদ্রগামী জাহাজকে পথ দেখায়, ঠিক সেইভাবে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পথ দেখিয়েছিলেন গোলাম আযম।

মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক সুলতানা কামাল বলেন, “নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে গোলাম আযম ছিলেন জার্মানির সাবেক শাসক হিটলারের সমকক্ষ, যিনি গণহত্যা কার্যকর ও জাতিসত্ত্বা নির্মূলে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন।”

আবুল আলা মওদুদীর মতাদর্শকে আশ্রয় করে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর গোড়াপত্তন করেন গোলাম আযম, যে দলটি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল।

ধর্মীয় উস্কানি সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানের আদালত মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল, একইভাবে ধর্মের জিগির তুলে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য গোলাম আযমেরও সাজা হল।

ইসলামের কথা বললেও মওদুদীর মতবাদ ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী অনেক মুসলিম পণ্ডিতই বলে আসছেন। দেশের ইসলামী দলগুলোর অনেক নেতাই একই কারণে জামায়াতের বিরোধী।

গোলাম আযমের জন্ম ১৯২২ সালে ৭ নভেম্বর ঢাকায় লক্ষ্মীবাজারে মামার বাড়িতে। তার বাবা গোলাম কবির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।

শুরুতে মাদ্রাসায় পড়লেও উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এমএ ডিগ্রি নেন তিনি। পরে রংপুর কারমাইকেল কলেজে কিছুকাল অধ্যাপনাও করেন তিনি।

গোলাম আযমকে ‘ভাষাসৈনিক’ বলে দাবি করে জামায়াতে ইসলামী। আর এর পক্ষে ১৯৪৮ সালে ডাকসুর জিএস হিসেবে লিয়াকত আলী খানকে বাংলা ভাষার দাবিতে স্মারকলিপি দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন তারা।

গোলাম আযমকে জুতাপেটার সেই ছবি

ওই বিষয়টি যে ঘটনাচক্র ছিল, তা রাজনীতিক-লেখক-গবেষক বদরউদ্দিন উমরের লেখায় স্পষ্ট। আর গোলাম আযম নিজেও পরে বলেছিলেন, বাংলার দাবিতে তার ওই অবস্থান ছিল ভুল।

মওদুদীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৯৫৪ সালে জামায়াতে যোগ দেন গোলাম আযম। ১৯৫৫ সালে গ্রেপ্তার হয়ে রংপুর কারাগারে অবস্থানকালেই জামায়াতের রুকন হন তিনি। ওই বছরই তিনি রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতের সেক্রেটারি হন।

এর এক বছর পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এবং রাজশাহী বিভাগের আমিরের দায়িত্ব পান। ১৯৫৭ সালে তিনি দলের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারির দায়িত্ব পান, ১৯৬৯ সালে পান আমিরের পদ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি গঠনের পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনী আল বদর ও রাজাকার বাহিনী গঠনও তার পরিকল্পনায় হয়েছিল।

একাত্তরের পুরোটা সময় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে এই ধরনের বক্তব্য-বিবৃতিতেই গোলাম আযমের অবস্থানের প্রকাশ ঘটে।

একাত্তরের ১২ অগাস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “তথাকথিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীরা ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু।”

তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন আগে পাকিস্তানে পাড়ি জমান গোলাম আযম।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডনে অবস্থান করে তখন তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচার চালান বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে গোলাম আযমের তৎপরতার কথা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৯২ সালে গণআদালতে উপস্থাপন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অসুস্থ মা’কে দেখার কথা বলে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসেন গোলাম আযম, তবে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে।

তিন মাসের জন্য এলেও আর ফেরেননি তিনি।

ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির বলেন, গোলাম আযমকে দেশে থাকতে দেয়ার বিরোধিতা তখন বিভিন্ন মহল থেকে উঠলেও তৎকালীন জিয়াউর রহমানের সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।

দেশে ফিরে দলীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে নিজের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখলেও ১৯৮১ সালে প্রথম প্রকাশ্য এক অনুষ্ঠানে গিয়ে জুতাপেটার শিকার হন গোলাম আযম।

এর এক দশক পর ১৯৯১ সালে জামায়াত তাদের আমির হিসেবে গোলাম আযমের নাম ঘোষণা করে, যা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে উঠলে ১৯৯২ সালের ২৪ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয় গোলাম আযমকে। তখন গণআদালতে ফাঁসির রায় হয় জামায়াতের শীর্ষ এই নেতার।

ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক শাহরিয়ার কবির বলেন, “জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় পড়ে শোনালে জনগণ চিৎকার করতে থাকে ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি। মাইক না থাকায় এক কণ্ঠ থেকে লাখো কণ্ঠে তা ছড়িয়ে পড়ে।”

তবে গোলাম আযম এরই মধ্যে হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে ১৯৯৪ সালে তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

রায়ে আইনি প্রশ্নে নাগরিকত্ব দিতে বললেও একইসঙ্গে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তার আনুগত্য ও সহানুভূতি পাকিস্তানের দিকেই ছিল। তিনি সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সহযোগী হিসাবে কাজ করেছেন।

আইনি লড়াইয়ে জিতলেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গোলাম আযমের বিচারের দাবিটি সব সময় ছিল।

এর মধ্যে ২০০০ সালের পর গোলাম আযম সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। আমিরের পদ ছাড়লেও দলের সব পর্যায়ে তার প্রভাব ক্রিয়াশীল।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচারের উদ্যোগ নেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে গ্রেপ্তার করা হয় গোলাম আযমকে। তবে বয়সজনিত বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালেই রয়েছেন।