যুদ্ধাপরাধের মূল হোতার ৯০ বছর জেল

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেওয়ার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু জেলে কাটাতে হবে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 July 2013, 01:55 AM
Updated : 15 July 2013, 10:51 AM

ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারক এ টি এম ফজলে কবীর সোমবার দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় ঘোষণা করেন।

ঐতিহাসিক এই রায়ে বলা হয়, অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি পাওনা হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় ৯১ বছর বয়সী এই আসামিকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

বিচারপতি কবীর বলেন, “তার যে অপরাধ এর সবগুলোই সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। তবে গ্রেপ্তারের পর থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ভর্তি আছেন। তার বয়স ও শরীরিক অবস্থা বিবেচনা করে এই সাজা দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে প্রথম দুটি অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার দায়ে ১০ বছর করে মোট ২০ বছর, তৃতীয় অভিযোগে অপরাধের উস্কানি দেয়ার দায়ে ২০ বছর, চতুর্থ অভিযোগে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করার দায়ে ২০ বছর এবং পঞ্চম অভিযোগে হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেয়ায় ৩০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে গোলাম আযমের।

রায়ের দিন থেকেই প্রতিটি অভিযোগের সাজা একের পর এক কার্যকর হবে। অর্থাৎ মৃত্যু না হলে টানা ৯০ বছর জেল খাটতে হবে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের ‘মূল হোতা’কে।

উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর অন্যতম প্রধান শিষ্য গোলাম আযম রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। তবে রায়ের পর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি সাদা পাঞ্জাবি ও টুপি পরিহিত এই জামায়াত নেতা ।

তার ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী দণ্ড ঘোষণার পর হেসে ওঠেন। বাবার কাছে গিয়ে বলেন- ‘সব ঠিক আছে, ফাঁসি হয়নি।’

একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের চার দশক পর এই বিচার নিয়ে অনেক প্রত্যাশা থাকলেও রায়ের পর প্রসিকিউশন এবং আসামির আইনজীবী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা, যারা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।

রায় প্রত্যাখ্যান করে জাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে গোলাম আযমের মুক্তির দাবিতে একই দিনে হরতাল ডেকেছে তার দল জামায়াতে ইসলামী।

আগের রায়গুলোর পর জামায়াতি সহিংসতার প্রেক্ষাপটে রোববার থেকেই ট্রাইব্যুনাল ঘিরে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে পুলিশ ও র্যর‌্যাব সদস্যরা। ট্রাইব্যুনালে আসা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদেরও কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তল্লাশি চালিয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। 

‘নাৎসি বর্বরতার সঙ্গে তুলনীয়’

রায় ঘোষণার জন্য গোলাম আযমকে সকাল ১০টা ৫ মিনিটে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। তাকে ভেতরে নেয়া হয় একটি হুইল চেয়ারে বসিয়ে।

প্রধান বিচারক ফজলে কবীর ১১টা ৮ মিনিটে রায়ের ভূমিকা পড়তে শুরু করেন।

তিনি বলেন, “গোলাম আযমের মামলাটি একটি ব্যতিক্রমী মামলা। অপরাধের সময় গোলাম আযম নিজে উপস্থিত না থাকলেও তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের পেছনের মূল ব্যক্তি ও নির্দেশদাতা হিসাবে।”

এরপর ২৪৩ পৃষ্ঠা রায়ের ৭৫ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দ্বিতীয় অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনালের অপর বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেন। শেষে ট্রাইব্যুনাল প্রধান সাজা ঘোষণা করেন।

পাঁচ ধরনের ৬১ ঘটনায় গোলাম আযমকে দোষী সাব্যস্ত করে এ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “অধীনস্তদের নেভেটিভ সিগন্যাল দিয়ে গোলাম আযম কার্যত হত্যায় অংশ নিয়েছেন। সুতরাং তিনি ক্রিমিন্যালি লায়্যাবল এবং দোষী।”

রায়ে বলা হয়, “গোলাম আযম সেই সময় বিভিন্ন বৈঠকে উপস্থিত থেকে ষড়যন্ত্রে অংশ নেন, পরিকল্পনা করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠনে ভূমিকা রাখেন বলে প্রমাণিত হয়েছে।”

গোলাম আযম বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে রাজাকার বাহিনীর সম্প্রসারণ ও তাদের জন্য অস্ত্র চেয়ে বক্তব্য দেন যার মাধ্যমে তিনি অপরাধ সংঘটনের উস্কানি দেন বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক।  

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি আনোয়ারুল হক বলেন, “একাত্তরে ম্যাসিভ জেনোসাইড হয়েছে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ।

“এটাকে কেবল নাৎসি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই তুলনা করা যায়।  আর সেই হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।”

এখনো ‘দেশবিরোধী অবস্থানে’ জামায়াত

রায়ে ট্রাইব্যুনাল প্রধান বলেন, “পাকিস্তান ও বাংলাদেশে- দুই দেশেরই স্বাধীনতার সময় জামায়াতে ইসলামী জনগণের মতের বিরুদ্ধে অন্যায্য আচরণ করে।”

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের ‘গুরু’ আবুল আলা মওদুদীর বিরোধিতা এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াত প্রধানের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিয়ে ফজলে কবীর বলেন, “জামায়াত যে সে সময় সাধারণ মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল- ঐতিহাসিক ওই দুই ঘটনাতেই তা দেখা যায়।”

জামায়াতের ‘দূরদৃষ্টির অভাবের’ পেছনে দলটির ‘উগ্র মৌলবাদী চেতনাকেই’ চিহ্নিত করেন ট্রাইব্যুনাল প্রধান।

তিনি বলেন, “এটা গভীর উদ্বেগের বিষয় যে জামায়াতের মৌল চেতনার মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী উপাদান এখনো বিদ্যমান। প্রজাতন্ত্রের নানা কাজেও তারা জড়িয়ে গেছে।” 

এরা যাতে আর সরকারি কাজে থাকতে না পারে সে বিষয়ে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন বিচারক।  

সংসদে দুটি আসনের অধিকারী জামায়াতের বাংলাদেশবিরোধী এই ভূমিকার কথা ট্রাইব্যুনালের আগের চারটি রায়েও উঠে আসে।

প্রতিক্রিয়া

রায়ের পর গোলাম আযমের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “এই রায়ে আমরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। আজ আইনের জন্য এটি একটি কালো দিবস।”

রায়কে ন্যায়ভ্রষ্ট ও আবেগতাড়িত আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের সব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও  গোলাম আযমের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে  প্রসিকিউশন।

চল্লিশ বছর অপেক্ষার পর ‘আংশিক ন্যায়বিচার’ পাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক এম কে রহমান বলেন, “উই আর নট হ্যাপি।”

প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, “দেশবাসীর আকাঙক্ষা ছিল রাজকারের সর্বোচ্চ নেতার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। এ বিষয়ে বিচারকরাও একমত যে, তার সর্বোচ্চ শাস্তিই হওয়া উচিৎ। এরপরও সর্বোচ্চ শাস্তি না দেয়ায় দেশবাসীর অনুভূতির সাথে একমত হয়ে আমরা বলছি, আমরা এ মামলায় আপিল করব।”

মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এই রায় প্রত্যাখ্যান করে সরকারের প্রতি আপিল করার আহ্বান জানিয়েছে। ফাঁসি না হওয়ায় ক্ষোভে প্রকাশ করেন ট্রাইব্যুনালের বাইরে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারাও।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, “গোলাম আযমের ৯০ বছরের জেলে আমি ব্যক্তিগতভাবে অসন্তুষ্ট। এ রায়ে জামায়াত যে দল হিসেবেও যুদ্ধাপরাধী তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।”

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, “এ রায় আমাদেরকে দুঃখ দিয়েছে। তাই আমাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ কাজ করছে।

রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আপিলের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও। তিনি বলেছেন, ‘রাজাকারের শিরোমনির’ দণ্ড লঘু করে ট্রাইব্যুনাল ন্যায়সংগত আচরণ করেনি।

অবশ্য প্রধান যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি না হলেও ট্রাইব্যুনালের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ।

দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, “আমরা আশা করেছিলাম, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। তা না হলেও ৯০ বছরের কারাদণ্ড হওয়ায় আমার মনে হয়, আমরা আদালতের এই রায়ে সন্তুষ্ট।”

রায়ে সরকার সন্তুস্ট কি না জানতে চাইলে আইন মন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের রায় সবাইকে মেনে নিতে হবে।

জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে এ রায় দেয়ার অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেছেন।

রায়ের বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি জামায়াতের জোটসঙ্গী বিএনপি।

এক নজরে গোলাম আযম

গোলাম কবির ও সৈয়দা আশরাফুন্নিসার সন্তান গোলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে তার নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিরগাওয়ে দাদাবাড়ির এলাকার একটি স্কুল থেকে প্রাথমিক, কুমিল্লার হুচা মিয়া মাদ্রাসা থেকে মাধ্যমিক এবং তখনকার ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (এখনকার কবি নজরুল কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি।

ছাত্রজীবন শেষে ১৯৫০ থেকে পাঁচবছর রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান গোলাম আযম। ১৯৫৪ সালে সাঈদ আল মওদুদীর ইসলামী ভাবধারায় প্রভাবিত হন এবং যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীতে। এরপর ধাপে ধাপে ১৯৬৯ সালে তিনি যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির হন, বাংলার মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন তখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। 

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান এই জামায়াত নেতা।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা; নাগরিকত্বও ফিরে পান। ১৯৯৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলেও দলটির তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে তিনি সম্পৃক্ততা বজায় রাখেন।

গোলাম আযম ফেরার পর থেকেই একাত্তরের ভূমিকার জন্য তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণ আদালতে প্রতীকী বিচার ও ফাঁসির রায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি চূড়ান্ত রূপ পায়।

সে সময় ক্ষমতাসীন সরকার সেই দাবিতে সাড়া না দিলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠনের মধ্য দিয়ে বহু প্রতীক্ষিত সেই বিচার কাজ শুরু হয়।

মামলার পূর্বাপর

বর্তমান সরকারের আমলে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর জামায়াতের অন্য শীর্ষ নেতাদের মতো গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধেরও তদন্ত শুরু হয়। ২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এর ভিত্তিতে ওই বছর ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ২০১২ সালের ১১ই জানুয়ারি গোলাম আযমকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠান। তখন থেকেই তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখা হয়।

এরপর পাঁচ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬১টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে গত বছরের ১৩ মে জামায়াতের এই সাবেক আমিরের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র, সহযোগিতা, উস্কানি ও হত্যাযজ্ঞে বাধা না দেওয়া এবং নির্যাতন চালানোর অভিযোগও রয়েছে।

এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হলেও গোলাম আযমের পক্ষে সাক্ষ্য দেন কেবল তার ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।

গত ১৭ এপ্রিল দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।

পঞ্চম রায়

গোলাম আযমের রায়ের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত এ ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম এবং সবচেয়ে বেশি প্রতীক্ষিত রায়টি এলো।

ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়।

তৃতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

সেই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতি সহিংস রূপ নেয়। বিচারের বিরোধিতাকারী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তোলে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো। 

এরই মধ্যে গত ৯ মে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

[আদালতের ভেতরে ও বাইরে থেকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন কামাল তালুকদার, সুলাইমান নিলয়, কাজী শাহরিন হক ও গোলাম মুজতবা ধ্রুব। প্রাসঙ্গিক তথ্য যুগিয়েছেন মঈনুল হক চৌধুরী, আশিক হোসেন, মামুনুর রশিদ ও আজিজ হাসান।]