বক্তব্য-বিবৃতিতে ‘যুদ্ধাপরাধের’ ছক

একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালিকে নির্মমভাবে দমন করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের ছয়টি, তাদের সহযোগিতা করার তিনটি এবং উস্কানি দেয়ার ২৮টি অভিযোগ আনা হয়েছে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2013, 08:10 PM
Updated : 14 July 2013, 08:10 PM

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বলছে, গোলাম আযম সেই সময় কেবল স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীকেই নেতৃত্ব দেননি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা এই ভূখণ্ডে বর্বর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তারই আঁকা ছকে, তারই নেতৃত্বে।

প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজের ভাষায়, বাতিঘর যেভাবে সমুদ্রগামী জাহাজকে পথ দেখায়, ঠিক সেইভাবে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরধীদের পথ দেখিয়েছিলেন গোলাম আযম।

আর এই অভিযোগের প্রমাণ মেলে জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামসহ ১৯৭১ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে। ‘১৯৭১: ঘাতক-দালালদের বক্তৃতা ও বিবৃতি’, ‘মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক সংগ্রমের ভূমিকা’সহ বিভিন্ন বই ও ব্লগেও এ বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

গোলাম আযমের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের সময় বিভিন্ন পত্রিকার এরকম ৪৩৫টি শিরোনাম তুলে ধরা হয় বিচারকদের সামনে। 

এই জামায়াত নেতা তার বিভিন্ন বক্তব্যে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থানকারীদের ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘দুষ্কৃতকারী’,‘ভারতের চর’, ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’,‘শত্রুবাহিনী’, ‘অনুপ্রবেশকারী’,‘ঘরে বসে থাকা দুশমন’ সম্বোধন করেন।

অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারীদের তিনি বলতেন ‘দেশপ্রেমিক জনতা’ ও ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’।

৮ এপ্রিল ১৯৭১

“ভারত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। ভারতীয় বা পাকিস্তানবিরোধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারী যেখানেই যাবে, সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের দেশ প্রেমিকরা তাদের নির্মূল করবে।”

ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযম

জামায়াত ইসলামীর তখনকার প্রচার সম্পাদক মওলানা নুরজ্জামান ও গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে এক যুক্ত বিবৃতিতে এই প্রতিজ্ঞার কথা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে জানান গোলাম আযম।

৯-১১ এপ্রিল ১৯৭১

“ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি যে সমর্থন ও সমবেদনা জানিয়েছেন, তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি।... পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে ভারত প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশপ্রেমের মূলে আঘাত হেনেছে। এ ধরনের অনুপ্রবেশ এ প্রদেশের মুসলমানদের কোনো কাজেই আসবে না।”

ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য দেয়ার আশ্বাস দিলে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানান গোলাম আযম। তার ওই বক্তব্য ১১ এপ্রিল দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়।

১৭ জুন ১৯৭১

“দুষ্কৃতকারীরা এখনো তাদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করা। পূর্ব পাকিস্তানের এমন নিভৃত অঞ্চল রয়েছে যেখানে দুষ্কৃতকারীরা জনগণকে পাকিস্তান রেডিও শুনতে দেয় না।”

এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন জামায়াতের তখনকার আমির।

১৮-২০ জুন

দৈনিক পাকিস্তান গোলাম আযমের বরাত দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে ‘কিছু সুপারিশ’ রাখবেন। তবে সেগুলো আগেভাগে প্রকাশ করা ‘ভালো’ হবে না।

পরদিন রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে গোলাম আযম। এরপর লাহোর বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সেই সুপারিশ প্রকাশ করেন।

“জনগণ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ সাহায্য ও সহযোগিতা দানে ইচ্ছুক, কিন্তু জীবননাশের হুমকি দেয়ায় তারা এ ব্যাপারে পূর্ণ সাহায্য করতে পারছে না। প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে পারলেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ করায়ত্ত করা সম্ভব হত।”

গোলাম আযমের এই বক্তব্য দৈনিক সংগ্রামে ছাপা হয় ২০ জুন। ‘দুষ্কৃতকারীদের’ মোকাবেলার জন্য জামায়াত আমির ‘দেশের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসীদের হাতে’ অস্ত্র তুলে দিতে সরকারকে আহ্বান জানান।

২১ জুন

“সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না।”

দৈনিক সংগ্রামের প্রতিবেদন অনুযায়ী লাহোরে দলীয় অফিসে গোলাম আযম কর্মীদের উদ্দেশে এ কথা বলেন।

২৩ জুন

“পূর্ব পাকিস্তানিরা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদের সাথে একত্রে বাস করবে।...নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।”

করাচির এক কর্মীসভায় গোলাম আযমের এই বক্তব্যও উঠে এসেছে তারই দলের মুখপত্রের পাতায়।

১৯ জুলাই

“যাদের নিজেদের শক্তি নেই, তারা হিন্দুস্থানের সাহায্যের উপর নির্ভর করে স্বাধীনতা চায়।... হিন্দুরা মুসলমানের বন্ধু-এরূপ প্রমাণ করার মতো কোনো দলিল নেই।”

রাজশাহীতে শান্তি কমিটির এক সমাবেশে এ কথা বলেন গোলাম আযম। দৈনিক সংগ্রাম তার ছবিসহ সেই খবর প্রকাশ করে।

৩ অগাস্ট

“এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, আদর্শিক যুদ্ধ। আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই দেশকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।”

মাদ্রাসা শিক্ষা সম্মেলনে গোলাম আযমের এই বক্তব্য উঠে এসেছে পরদিনের সংগ্রামের প্রতিবেদনে।

১৪ অগাস্ট

“পাকিস্তানের দুশমনদের মহল্লায় মহল্লায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলোপ করার জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিক শান্তি কমিটির সাথে সহযোগিতা করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাই।”

একাত্তরে এক বৈঠকে গোলাম আযম, রাও ফরমান আলী ও এম এ মালেক

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির এক সভায় এ কথা বলেন গোলাম আযম।

২ সেপ্টেম্বর

“বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খতম করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সকল একমনা ও দেশপ্রেমিক জনগণ এক সাথে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে রেজাকাররা ভালো কাজ করছে।”

গোলাম আযমকে উদ্ধৃত করে দৈনিক পাকিস্তানের এক প্রতিবেদনে এ কথা প্রকাশিত হয়।

আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনে যা দেখলাম’র তৃতীয় খণ্ডেও রাজাকারদের প্রতি গোলাম আযমের এই ‘স্নেহের’ প্রমাণ পাওয়া যায়।

ওই বইয়ের ১৫০ পৃষ্ঠায় গোলাম আযম লিখেছেন- “যে রেযাকাররা দেশকে নাশকতামূলক তৎপরতা থেকে রক্ষার জন্য জীবন দিচ্ছে তারা কি দেশকে ভালবাসে না? তারা জন্মভূমির দুশমন হতে পারে?”

২৭ নভেম্বর

“কোনো জাতি যুদ্ধকালে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা ছাড়াই টিকতে পেরেছে, এমন নজির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আত্মরক্ষা নয়, আক্রমণই এখন সর্বোত্তম পন্থা।”

রাওয়ালপিণ্ডিতে এক সমাবেশে গোলাম আযমের এই বক্তব্য পরদিন দৈনিক সংগ্রামে ছাপা হয়।

২ ডিসেম্বর

“বর্তমান সংকট মোকাবিলার জন্য জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করবে। শত্রুবাহিনীকে মোকবিলা করার জন্য রাজাকাররাই যথেষ্ট।”

দৈনিক ইত্তেফাকের খবর অনুযায়ী, রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন গোলাম আযম। ততদিনে পাকিস্তানি হানাদাররা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে, স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের আর কয়েকটি দিন মাত্র বাকি।

এর আগে ২২ নভেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন গোলাম আযম। তার সঙ্গে ছিলেন মাওলানা আব্দুর রহীম ও এ কে এম ইউসুফ। ১৯৭৮ সালের আগে আর বাংলাদেশে ফেরেননি তিনি।