শিক্ষাবর্ষের অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলেও বই পৌঁছেনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীদের হাতে।
Published : 25 Jun 2013, 01:01 PM
প্রতিবারের মতো এবারো বছরের প্রথম দিন স্কুলে স্কুলে ঘটা করে বই উৎসব হয়। এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠান করে দেশের ৩০টি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একটি করে বইয়ের সেটও বিতরণ করেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু মাঝ বছরেও বই না পেয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা।
অভিভাবকরা বলছেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির পাঠ্যবইয়ের সঙ্কট সবসময়ই ছিল। তবে এবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন ১০৪টি বই প্রণয়ন করায় সঙ্কট নতুন রূপ পেয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নতুন এসব বইয়ের ‘সফটকপি’ সরবরাহে দেরি করায় ব্রেইল পদ্ধতির বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে এই বিলম্ব বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
খিলক্ষেত জানে আলম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আসিফ করিম পাটোয়ারি রূপম বলেন, “বছরের প্রথম দিন বই উৎসব হলো। সবাই আনন্দ করে নতুন বই নিল। কিন্তু আমার বই দিল না। আমার হাফইয়ার্লি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পথে। এখনো নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে পারলাম না।”
রূপমের মা রুমা লায়লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাইরে থেকে অর্ডার দিয়ে অনেক কষ্টে ওর জন্য বাংলা আর ইংরেজি বই দুটো করিয়ে নিয়েছি। বাকি বিষয়গুলো পড়ে পড়ে শুনিয়ে ওকে পরীক্ষার জন্য তৈরি করছি।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় থাকা দেশের পাঁচটি বিভাগীয় শহরে শ্রবণ-দৃষ্টি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি করে বিশেষায়িত স্কুল এবং ৬৪ জেলায় একটি করে সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমের স্কুল রয়েছে। এরমধ্যে ২৮টি স্কুল গণিত ও ধর্মশিক্ষা বাদে প্রাথমিকের বইগুলো পেলেও মাধ্যমিকের কোনো বিষয়েরই ব্রেইল বই শিক্ষার্থীরা পায়নি। আর বেসরকারি স্কুলগুলো সরকার থেকে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক কোনো পর্যায়েরই বই পায় না।
রাজধানীর কচুক্ষেতে সরকারি বিশেষায়িত স্কুলের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “প্রাথমিকের বাংলা, ইংরেজি ও সমাবিজ্ঞান বই আমরা পেয়েছি। কিন্তু গণিত ও ধর্মশিক্ষার বই তৈরি না হওয়ায় এখনো তা পাইনি।”
একইভাবে প্রাথমিকের কিছু বই গেলেও চট্টগ্রামের মুরাদপুরে সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলের মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৭জন শিক্ষার্থীর হাতে কোনো বই পৌঁছায়নি।
কবে নাগাদ বই পাওয়া যাবে জানতে চাইলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল সামাদ হতাশ কণ্ঠে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগামী বছর পাব হয়তো।”
“কিন্তু এবার আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই বছরে একসঙ্গে এতোগুলো বইয়ের পরিবর্তন আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে।”
বই নিয়ে আক্ষেপ ঝরলো এই স্কুলেরই নবম শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী নাজিয়া হাসান মায়েশার কণ্ঠেও।
“এই সমস্যা তো সবসময়ই চলছে। খুব চেষ্টা করি শুনে শুনে পড়া মনে রাখার। কিন্তু সৃজনশীল বিষয়গুলো তো আর মনে রেখে হয় না। যারা চোখে দেখতে পায় তারা মূল বইয়ের পাশাপাশি আরো কতো সুবিধা পায়। অথচ আমাদের একটা রেকর্ড পর্যন্ত দেয়া হয় না।”
রংপুরের ‘রাইট টু সারভাইভ’ স্কুলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জন।
এই স্কুলের শিক্ষক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রুবি আক্তার বলেন, “সরকারি বই তো আমরা পাই না। এবার বছরের প্রথমে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে একটা তালিকা নিল। কিন্তু এ বিষয়ে পরে যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। দিনের পর দিন এভাবেই আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।”
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠনের নেটওয়ার্ক ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফোরামের’ সমন্বয়ক পারভীন মজুমদারও একই কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম এবার অন্তত বেসরকারি স্কুলগুলো সরকারি বই পাবে। বছরের প্রথমেই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আমাদের কাছ থেকে একটা তালিকা নিলেও পরে আর কোনো খোঁজ নেয়নি।”
আর বইয়ের অভাবে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি নিয়ে সেন্টারের প্রধান শিক্ষক তোরা বিশ্বাস বলেন, “টাকা নিয়ে বসে অাছি, কিন্তু বাজারে বই নেই। ব্রেইল বই ছাড়া বাচ্চাদের তৈরি করতে দ্বিগুণ পরিশ্রম করছি। কিন্তু এতে করে বাচ্চাদের যে কষ্ট সেটা সহ্য করা কঠিন।”
এ বিষয় নিয়ে কথা হয় সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের ‘সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের এক কর্মকর্তার সঙ্গে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় ২৮টি জেলার সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমের স্কুলে প্রাথমিকের বইগুলো দেয়া হয়েছে। তবে মাধ্যমিকের বইগুলো নিয়ে এখনো কাজ চলছে।
এসব বইয়ের ‘সফটকপি’ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে পেতে অনেক দেরি হওয়ায় এখনো সেগুলো তৈরি করা যায়নি বলে জানান এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “একটা বই ব্রেইলে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তাই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে আরো অন্তত দুমাস সময় লাগবে।
তবে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাসিমা বেগম বলেন, “যারা বই পায়নি তারা হয়তো আমাদের নিবন্ধিত নয়। আমি খোঁজ নিচ্ছি। এনসিটিবি থেকে যে ডিমান্ড ছিলো সেগুলো দিয়েছি।”
আর বেসরকারি স্কুলে বই না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে আমাদের কাছে আগে থেকে চাহিদাপত্র দিতে হবে। নাহলে বেশি বই ছাপিয়ে আমরা কি করব?”
বর্তমানে অধিদপ্তর পরিচালিত ‘দেশব্যাপী প্রতিবন্ধী সনাক্তকরণ’ জরিপ শেষ হলে এই সমস্যা থাকবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এ রকম বেসরকারি উদ্যোগে কিছু ব্রেইল বই প্রকাশ হলেও অতিরিক্ত দামের কারণে অভিভাবকরা তা কিনতে হিমশিম খান।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করা চাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশনের (সিএসএফ) এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এসব শিশুর একটি বড় অংশ দরিদ্র পরিবার থেকে আসা।
সিডিডির সমন্বয়ক ব্রজগোপাল সাহা জানান, নতুন কারিকুলামের প্রথম শ্রেণির জন্য তিনটি বিষয় নিয়ে এক সেট ব্রেইল বই তৈরিতে খরচ পড়ছে এক হাজার পাঁচশ টাকা।
একইভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য এক সেটে (তিনটি বিষয়) ১৫৫০ টাকা, তৃতীয় শ্রেণির এক সেট (ছয়টি বিষয়) চার হাজার পাঁচশ, চতুর্থ শ্রেণির এক সেট (৬টি বিষয়) ছয় হাজার চারশ টাকা এবং পঞ্চম শ্রেণির এক সেটে (৬টি বিষয়) সাত হাজার ৯০০ টাকা খরচ হয়।
আর ‘বহুবার’ চাওয়ার পরও এনসিটিবির কাছ থেকে মাধ্যমিকের বইয়ের ‘সফটকপি’ না পাওয়ায় সেগুলোর কাজ শুরু করা যায়নি বলে জানান তিনি।