সরকারি চাকরিতে কোটার ‘ফাঁদ’

সরকারি চাকরির ‘কোটার ফাঁদে’ বাদ পড়তে হচ্ছে মেধাবী অনেককে।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 June 2013, 10:26 PM
Updated : 22 June 2013, 01:38 AM

এ থেকে উত্তরণে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সরকারি কর্মকমিশন- পিএসসি বিভিন্ন সময় সুপারিশ করে এলেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।

খোদ পিএসসি এই পদ্ধতিকে সরলীকরণের তাগাদা দিয়ে বলেছে, এটি অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময় সাপেক্ষ। শতভাগ নিখুঁতভাবে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন এর মাধ্যমে প্রায় অসম্ভব।

তবে সংস্কারের দায়িত্ব সরকারের জানিয়ে পিএসসির চেয়ারম্যান এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বহুবার কোটা পদ্ধতি সহজীকরণের সুপারিশ করেছি।”

বর্তমানে দেশে পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য। প্রতিবন্ধী এক শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে। সব মিলিয়ে কোটার জন্য বরাদ্দ ৫৬ শতাংশ।

ফলে এর কোনো শ্রেণিতে যারা পড়েন না, তাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাকি ৪৪ শতাংশের জন্য।

পঞ্চম আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১২ জন প্রতিবন্ধী।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ।

এই হিসেবে মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষিত থাকছে পাঁচ শতাংশ, ১ দশমিক ৪০ শতাংশ প্রতিবন্ধীর জন্য এক শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খানও বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেক বলেন, “অধিকাংশ কোটাই অসাংবিধানিক ও ন্যায়নীতির পরিপন্থী।”

মেধা কোটা ৫০ শতাংশের কম হওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।

আকবর আলি বলেন, “কোনো কোটাই চিরদিন থাকতে পারে না। প্রত্যেক কোটার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। দেশে যখন ১৭ জেলা ছিল তখন চালু হয় ‘জেলা কোটা’। পরে ১৭ জেলা ভেঙে ৬৪টি করা হলেও সেই কোটাই রয়ে গেছে। অন্যদিকে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।”

সরকারি চাকরিতে ২৫৭ রকমের কোটা প্রচলিত আছে তথ্য দেন এই সাবেক আমলা।

মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিবের দায়িত্ব পালনকারী আকবর আলি বলেন, ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করা হয়।

 “ওই সময় তাদের অবদান ও বিড়ম্বনার কথা বিবেচনা করে এটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পরেও জন্ম নেয়া তাদের সন্তানের বেলায় এটা প্রয়োগের কোনো যুক্তি নেই।”

সংবিধানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির কথা বলা হলেও সেই অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কারা এবং কত দিন ধরে তাদের কোটা দেয়া যেতে পারে তা নতুন করে ভাবতে হবে বলেও মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, “১০ শতাংশ জেলা কোটা থাকায় বেশি জনসংখ্যার জেলাগুলোর মানুষ বেশি চাকরি পাচ্ছেন, যা এক ধরনের বৈষম্য।”

দুই বার বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা দিয়েও চাকরি না পাওয়া রেজোয়ান আহমেদ এজন্য কোটা পদ্ধতিকে দায়ী করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোটা উঠিয়ে দেয়ার দাবি করছি না। তবে কোটা পদ্ধতির সংস্কার চাই। আমরা যারা কোনো কোটার মধ্যেই নেই, তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।”

পিএসসি চেয়ারম্যান আহমেদুল হক বলেন, কোটা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব তাদের নয়।

“কোটা নির্ধারণ করে দেয় সরকার, তা আমাদের বিষয় নয়। তবে আমরা কোটাকে সহজীকরণের কথা দীর্ঘ দিন থেকেই বলে আসছি।”

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন সচিব আব্দুস সোহবান সিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সরকারের আপাতত কোনো উদ্যোগ নেই। তবে জেলা কোটা নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে।”

বিদ্যমান কোটা পদ্ধতিতে ‘বৈষম্য’ করা হচ্ছে- এ অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “চলমান বিসিএস পরীক্ষায় নারী, উপজাতি ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা থেকে প্রার্থী না পাওয়া গেলে তা মেধা কোটা থেকে পূরণ করতে বলা হয়েছে। তবে এটা কিন্তু আজীবনের জন্য নয়। শুধু এই বিসিএসের জন্য।”

এদিকে সরকারি চাকরিতে বিদ্যামান কোটা পদ্ধতির ‘সংস্কার’ করতে বেশ কয়েকবার সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন- পিএসসি।

২০০৯ ও ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে পিএসসি বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করে বলে, “বর্তমানের কোটা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।”

“প্রচলিত কোটা পদ্ধতির জটিলতার কারণে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে সম্পাদন করা প্রায় অসম্ভব। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের জন্য বর্তমানে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সরলীকরণ অপরিহার্য। অন্যথায় কোটা প্রয়োগ জটিলতা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।”

১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন সদস্য বাদে সবাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন।

কোটার পক্ষে অবস্থা নেয়া এম এম জামান প্রচলিত কোটাগুলো প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন।

কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়।

পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ ভাগ কোটার অল্প সংখ্যকই পূরণ হচ্ছে।

গত ২১, ২২ ও ২৫ তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২ ও ৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়। আর ২৮তম বিসিএসে পেশাগত ও কারিগরি ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় ৮১৩টি পদের জন্য কোনো যোগ্য প্রার্থীই পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ খালি থাকে। পরে এসব পদে নিয়োগ দিতে ৩২তম বিশেষ বিসিএস হয়। এর আগেও ২০০০ সালে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য একটি বিশেষ বিসিএস নেয়া হয়েছিল।