বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টায় তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ‘চূড়ান্ত করছে’ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতের ইউপিএ সরকার।
Published : 04 Jun 2013, 06:11 AM
২০১১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।
চুক্তি আটকে যাওয়ার বিষয়টি সে সময় শেখ হাসিনা সরকারকে দারুণভাবে হতাশ করে। বাংলাদেশ আশা করেছিল, আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পর এবার তিস্তা চুক্তিও ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায় কেবল মনমোহনের উদ্যোগের বিরোধিতাই করেননি, তিস্তা চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দাবি করে ওই চুক্তির বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান নেন তিনি।
এরপর তিনি তিস্তার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য ভারতের বিশিষ্ট পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে দায়িত্ব দেন, যিনি গত বছর প্রতিবেদনও জমা দিয়েছেন।
ওই প্রতিবেদনে রুদ্র বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদী তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত তিস্তার পানি প্রত্যাহারের বিরোধিতা করেন।
অবশ্য ওই প্রতিবেদনে দৃশ্যত অসন্তুষ্ট মমতা সেটি ফাইলবন্দিই করে রাখেন।
রুদ্র কমিশনের সেই প্রতিবেদনের কপি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে পৌঁছানোর পর মমতার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তিস্তা চুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ‘জোর’ পেয়েছেন মনমোহন সিং।
কেন্দ্র সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিস্তা চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থহানী হবে - এমন দাবির বিপরীতে দাঁড়াতে এখন আমরা প্রস্তুত।”
দিল্লিতে গুঞ্জন, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ইতোমধ্যে তিস্তা চুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সবুজ সংকেত দিয়েছেন, সেটা মমতা বন্দোপাধ্যয়ের সমর্থন না পাওয়া গেলেও।
আর সেক্ষেত্রে ২০১১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে চুক্তির যে খসড়া তৈরি হয়েছিল তাতে ‘সামান্য’ কিছু পরিবর্তন এনে নতুন করে প্রস্তুত করা হবে, যাতে আসছে সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য দিল্লি সফরেই চুক্তিতে সই করা সম্ভব হয়।
কর্মকর্তারা বলছেন, খসড়ায় যে পরিবর্তনগুলো আনা হবে, কল্যাণ রুদ্রের প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতেই সেগুলো করা হবে।
চলতি বছর মার্চে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরের সময় শেখ হাসিনা এটা এক প্রকার স্পষ্ট করে দেন যে, ভারত তিস্তা চুক্তিতে রাজি হলে তবেই তিনি দিল্লি সফরে যাবেন।
ভারতে মনমোহন সিংয়ের জোট সরকার এখন আর মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের ওপর নির্ভরশীল নয়। ২০১৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কংগ্রেস আবারো তৃণমূলের সমর্থন পাবে, এমন আশাও মনমোহন করছেন না।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারাভিযানে মমতা তো ঘোষণাই দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে দিল্লি থেকে ইউপিএ সরকারকে টেনে নামানোই হবে তার প্রথম কাজ।
ভারতীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দল বিজেপি ইতোমধ্যে মমতার সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখছে। এর বাইরেও বিভিন্ন দলের সঙ্গে মিলে আলাদা মোর্চায় যাওয়ার সম্ভবনাগুলো খতিয়ে দেখছে তৃণমূল। ফলে আবারো মমতার সমর্থন পাওয়ার কোনো আশা কংগ্রেসের সামনে আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
তাছাড়া তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের সমর্থন লাগবেই- এমন কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কেন্দ্র সরকারের নেই বলে দিল্লির কর্মকর্তারা মনে করছেন। যদিও ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তি করার সময় তখনকার প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মতামত নিয়েছিলেন। মনমোহনও সে অনুসারে মমতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
দিল্লির সেই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এখন নিশ্চিত হয়েছি যে, তিস্তা চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মূল বিষয় নয়। তিনি বিরোধিতা করছেন অন্য কারণে। সুতরাং বাংলাদেশের মতো একটি ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশকে আমরা হতাশ করতে পারি না।”
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে যে দিক দিয়ে তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সেখানে মমতার তৃণমূলের চেয়ে কংগ্রেস অনেক বেশি শক্তিশালী।
ওই এলাকায় তিস্তা চুক্তির পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরী, আবু হাশেম খান চৌধুরী ও দীপা দাস মুন্সীসহ কংগ্রেসের স্থানীয় এমপিদের ‘নিরব’ প্রচার শুরুরও নির্দেশনা দিয়েছেন মনমোহন, যাতে চুক্তির সময় তৃণমূল সেখানে জটিলতা সৃষ্টি করতে না পারে।
আর সম্প্রতি মমতা সরকার পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ দেখিয়েছে, তাতে এই এমপিরাও মমতার কড়া সমালোচক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন।