'হেফাজতের দাবি মানা হয়েছে, হচ্ছে'

ঢাকা অবরোধের ঘোষণা দেয়া হেফাজতে ইসলামের বেশিরভাগ দাবিই বাস্তবায়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে এ কর্মসূচি বাদ দেয়ার অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2013, 01:03 PM
Updated : 3 May 2013, 01:04 PM

শুক্রবার সন্ধ্যায় গণভবনে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়েই ছিল হেফাজতের ইসলামের বিভিন্ন দাবি দাওয়া এবং সে বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপের প্রসঙ্গ।

সাভারে উদ্ধার অভিযান ও পুনর্বাসন কাজের স্বার্থে হেফজতে ইসলামের রোববারের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হেফাজতের ১৩ দফা দাবির ১২টি পড়ে শোনান।

"হেফাজতে ইসলামের নেতারা বেশ কিছু দাবি-দাওয়া পেশ করেছেন। এ ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলতে চাই। যে দাবিগুলো তারা করেছেন তার অনেকগুলোই কিন্তু ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আমরা কিছু কিছু করেছি। কিছু দাবি বাস্তবায়নের পথে যেগুলোর যৌক্তিকতা রয়েছে। যদি কিছু থাকে, তা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যেতে পারে।"

হেফাজতে ইসলামের সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপনের দাবি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম দেওয়াই আছে। এটা ইতিমধ্যেই আছে। তাছাড়া সংবিধানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও লেখা আছে। সুতরাং ইসলাম ধর্ম সংবিধান থেকে বাদ যায় নাই।"

আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে শাস্তির দাবিতে হেফাজতের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে শেখ হাসিনা বলেন, "ধর্মের অবমাননার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রেখে দেশে আইন কিন্তু বিদ্যমান আছে।"

এক্ষেত্রে তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইন, দণ্ডবিধি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরে বলেন, "তিন তিনটা আইনেই কিন্তু ধর্ম ও নবী করিম (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করলে শাস্তির বিধান আছে।

নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করার দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "ইউটিউবে কুরআন শরীফ ও নবী (সা.) সম্পর্কে খারাপ ছবি দেয়া হয়েছিল। আমরা কিন্তু তা বন্ধ করে দিয়েছিলাম, এখানে কিন্তু কারো দাবি করা লাগে নি। নিজেদের মনের তাগিদেই আমরা করেছি।"

ইতোমধ্যে হজরত মুহাম্মদ (সা:) এর প্রতি কুৎসা রটনাকারী ৪ জন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি জানান, ভবিষ্যতে অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী পড়ে শোনান, "তাদের দাবি হচ্ছে, রাসূল (সাঃ) প্রেমিক প্রতিবাদী আলেম ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র এবং তৌহিদী জনতার উপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলি বর্ষণ এবং হত্যাকান্ড বন্ধ করতে হবে।"

"আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, শান্তিপ্রিয় এবং নিরাপরাধ আলেম ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র, ইমাম খতিব ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আলেমরা আমাদের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কোনো আলেম ওলামার উপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও গুলিবর্ষণ করার ঘটনা ঘটেনি।"

কোনো আলেম-ওলামা বা মাদ্রাসা ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "জানামতে যদি কোন নির্দোষ আলেম গ্রেপ্তার হয়ে থাকে, তবে তালিকা প্রদান করলে অবশ্যই সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে তাদের মুক্তি দিবে।"

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করাতে হেফাজতের বক্তব্যের প্রতি সরকারের কোনো দ্বিমত নেই বলে জানান সরকার প্রধান।

কিন্তু খুতবার সময় কারো বিরুদ্ধে গীবত যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হেফাজতে ইসলামের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, হেফাজতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্জ্¦লনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

"ব্যক্তি ও বাক স্বাধনিতার নামে বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার ইত্যাদি বাঙালি ও বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধে সরকার সচেষ্ট রয়েছে।"

ব্যাভিচার সরকার কোনোভাবেই পছন্দ করে না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "উল্লেখ্য ব্যভিচার দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় দন্ডনীয়। ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে কিন্তু আইন রয়েছে। কেউ যদি কোনো রকম ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় তাতে শাস্তি দেয়া যায়। সেটাও কিন্তু আমরা আইনে রেখেছি।"

তবে বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতি জ্বালাতে হয় বলে মনে করিয়ে দেন তিনি। মক্কা-মদিনাতেও মশাল জ্বালানো হতো বলে উদাহরন টানেন।

মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তরের অভিযোগ এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করার যে দাবি হেফাজতে ইসলাম করছে সে প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌদি আরবে, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে ভাস্কর্য রয়েছে।

আর মুর্তির সজ্ঞা দিয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "মুর্তি কোনটা, হিন্দুরা যখন পুজা করার উদ্দেশে কোনো মাটির মুর্তি তৈরি করে সেটা হচ্ছে মুর্তি। কিন্তু কোনো নির্দশন হিসেবে যখন কোনো ভাস্কর্য তৈরি করা হয় সেটা কিন্তু মুর্তি না।"

সরকার কোনো ধরনের অশ্লীল ভাস্কর্য তৈরি করতে দেবে না বলে জানান তিনি।

'ইসলাম বিরোধী নারী নীতি' ও 'ধর্মহীন শিক্ষানীতি' বাতিল করে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি প্রসঙ্গে প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী করেন, "আমাদের সরকারই সর্বপ্রথম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে যেখানে মাধ্যমিক পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে।

"ধর্ম শিক্ষা যখন বাধ্যতামূলক করেছি, তখন কিন্তু দাবি তোলার প্রয়োজন হয় নাই", যোগ করেন তিনি।

নারী নীতি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, "সংশোধনীতে আমরা একটা লাইন সংযুক্ত করে দিয়েছি যে, এই নীতিতে যদি আমাদের ইসলাম ধর্মের বা পবিত্র কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো নীতি বা আইন থাকে তা আমরা কথনও করবো না, বা আইন আমরা প্রণয়ন করব না।"

তিনি উল্লেখ করেন, "ইসলাম ধর্ম নারীকে সবচেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছে। সে অধিকার কেড়ে নেওয়া তো ইসলাম ধর্মের নীতি না। একমাত্র ইসলাম ধর্মে নারীকে সব ধরনের অধিকার নিশ্চিত করেছে।

তারা বলেছেন, সারাদেশে কওমী মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক, ওলামা মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম ও খতীবকে হুমকী, ধামকি ও ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে কওমী মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক, ওলামা মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম ও খতীবকে হুমকি, ধামকি ও ভয়ভীতি দেয়া হচ্ছে না উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা করা হচ্ছে বলে হেফাজতে ইসলাম যে দাবি করছে সে প্রসঙ্গে 'সম্পূর্ণ একমত' পোষণ করেন হাসিনা।

"রাজাকারকে চিহ্নিত করতে গেলেই এ বিষয়টা আসে। এটাতো ঠিক, দাড়ি আর টুপি থাকলেই তো কেউ রাজাকার না। আমার আওয়ামী লীগে সবচেয়ে বেশি দাড়ি ও টুপি পড়া লোক আছে।"

প্রধানমন্ত্রী এটা না করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, "এটা আমারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে।"

হেফাজতে ইসলামের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত এনজিও, কাদিয়ানী অপতৎপরতা এবং খ্রিষ্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরসহ সকল অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।

জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "পার্বত্য এলাকায় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে তাদের দারিদ্র এবং অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কোন এনজিও অথবা কোন সংগঠন যাতে অপতৎপরতা চালাতে না পারে সে বিষয়ে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর নজরদারী রয়েছে।"

হেফাজতে ইসলামের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, "আসুন, শান্তির ধর্ম ইসলামকে হৃদয়ে ধারণ করে সবাই দেশের উন্নয়নের জন্য, জনগণের স্বার্থে একসাথে কাজ করি।"

পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে ধর্মের মান-মর্যাদা যেন কেউ ক্ষুন্ন করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি ও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ওলামা-মাশায়েখদের প্রতি আবেদন জানান প্রধানমন্ত্রী।

স্মরণ করিয়ে দেন, "যে কোন ধরণের হঠকারিতা বা দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকান্ড বা বক্তব্যের কারণে দেশ, জাতি ও গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এটি আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না।"