জেল হত্যায় মারফত ও হাশেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড

কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যামামলায় হাই কোর্টের রায়ে বাদ পড়লেও দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 April 2013, 08:49 PM
Updated : 30 April 2013, 06:56 AM

মঙ্গলবার দেয়া আপিল বিভাগের এই রায়ে সন্তোষ জানিয়েছে নিহতদের পরিবার, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে যাদেরকে হত্যা দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।

আলোচিত এই মামলার বহু প্রতীক্ষিত আপিলের রায় দেয় প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চ।

রাষ্ট্রপক্ষের আপিল মঞ্জুর এবং নিম্ন আদালতের রায় বহাল, এক কথায় রায় দেয় আদালত।

রায়ে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলেও এই ষড়যন্ত্রে জড়িতদের শাস্তিও প্রত্যাশা ছিল জাতীয় নেতাদের পরিবার ও রাষ্ট্রপক্ষের।

আপিলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে এই বিষয়ে না থাকায় আদেশে কিছু বলা হয়নি, তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে এই বিষয়ে মত পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে কোনো আদেশ না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন হত্যাকাণ্ডের শিকার এম মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম।

অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেছেন, এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করবেন তারা।

তবে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক বলেছেন, দুই আসামি পলাতক থাকায় রিভিউ আবেদনের সুবিধা তারা পেতে পারেন না।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।

ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান মামলার রায় দেন। এতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে ২০০৮ সালে হাই কোর্ট মোসলেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেয়।

বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়।

২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে।

কাকতালীয়ভাবে গত ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে এই চার নেতা হত্যা মামলার চূড়ান্ত আইনি লড়াইয়ের শুনানি শেষ হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে এই চার নেতার নেতৃত্বে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার নিভৃত এক আমবাগানে শপথ নিয়েছিল স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকার।

যুক্তিতর্কে রাষ্ট্রপক্ষ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তির পাশাপাশি ষড়যন্ত্রকারীদেরও শাস্তি চায়। আপিল বিভাগ সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের আলোকে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করতে এ ধরনের আদেশ দিতে পারে বলে যুক্তি দেখায় রাষ্ট্রপক্ষ।

অন্যদিকে আসামিপক্ষ দফাদার মারফত আলী শাহ ও হাসেম মৃধার (পলাতক) খালাসে হাই কোর্টের রায় বহাল চায়।

একইসঙ্গে ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ বিষয়টা আপিলে না থাকায় তাদের বিষয়ে আপিল বিভাগ আদেশ দিতে পারে না বলে যুক্তি দেয় আসামি পক্ষ।

এই আপিলে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন এই মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদায় নিযুক্ত আইনজীবী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

অন্যদিকে আদালত নিযুক্ত আইনজীবী হিসাবে আসামিপক্ষের  শুনানি করেন ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এটি একটি বিতর্কিত রায় হয়েছে। কারণ এই হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে এই দুই আসামিকে নিম্ন আদালত যাবজ্জীবন এবং মৃত্যুদণ্ড উভয়টি দেয়।

“আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে এক অপরাধের জন্য দুইবার দণ্ড দেয়া যায় না। রায়ে এটি একটি ভুল। আদালত রায়ে ওই যাবজ্জীবন দণ্ডের বিষয়ে কিছু বলেনি। এক দণ্ড বহাল থাকতে অপর দণ্ড হতে পারে না।”

এই ‘ভুল’ সংশোধনের জন্য রিভিউ আবেদন করা হবে বলে জানান আল মামুন।

আদালত নিযুক্ত আইনজীবী রিভিউ করতে পারেন কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “রিভিউ আপিলেরই একটি পার্ট। সঠিক রায় না পাওয়া পর্যন্ত আমি এই মামলায় আদালত নিযুক্ত আসামি পক্ষের আইনজীবী। তাই আমি রিভিউ করতে পারবো।”

তবে আনিসুল হক বলেন, “আপিল-রিভিউ ইত্যাদি কোনো পলাতক ব্যক্তি করতে পারেন না। আপিল বিভাগে যে আবেদনে তিনি আদালত নিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন, সেই আপিল কিন্তু আসামিরা দায়ের করেনি।

“পলাতক হওয়ায় আইন অনুসারে তারা তা করতে পারেন না। তাই বলা যায়, আদালত নিযুক্ত আইনজীবী রিভিউ দাখিল করতে পারেন না।”

রিভিউ করতে হলে অবশ্যই আসামিদের আত্মসমর্পণ করতে হবে, বলেন আনিসুল হক।

ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, “এই মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই ঘটনায় ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এ বিষয়ে কোনো রিভিশন বা আপিল হয়নি, তাই আদালত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো আদেশ দিতে পারে না।”

হাই কোর্ট ফাঁসির তিন আসামির মধ্যে শুধু দুজনকে খালাস দেয়ায় রায়ের ওই অংশটির বিরুদ্ধে আপিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। পলাতক আসামিদের পক্ষে আপিলের কোনো আবেদন হয়নি।

এই মামলায় বিচারিক আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় সেনা কর্মকর্তা খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, বজলুল হুদা, এমএইচএম বি নূর চৌধুরী, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, এএম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, আবদুল মাজেদ, মো. কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে।

ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনকেও খালাস দিয়েছিল হাই কোর্ট। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যামামলায় এই চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অন্যরা পলাতক।

এদের মধ্যে মেজর আহমদ শরফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাশেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ছাড়া বাকিরা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তারা এখনো পলাতক রয়েছেন।

নিম্ন আদালতের রায়ে খালাস পান বিএনপি নেতা কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, সেনা কর্মকর্তা মো. খায়রুজ্জামান ও আজিজ পাশা।