‘নারীবিরোধী’ এক সমাবেশ

নারীবিহীন হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য যেমন ছিল, তেমনি পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে লাঞ্ছিতও হতে হয়েছে নারী সাংবাদিকদের।

মঈনুল হক চৌধুরীরিয়াজুল বাশার ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2013, 10:21 AM
Updated : 7 April 2013, 07:49 AM

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি যখন সারাবিশ্বে আলোচিত, তখন নারীদের ওপর হামলা এবং তাদের অগ্রযাত্রার পথ রুদ্ধ করার দাবি তোলার নিন্দা জানিয়েছেন নারীনেত্রীরা।

‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তির দাবিটি সামনে রেখে শনিবার ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশ হলেও তাদের যে ১৩টি দাবি রয়েছে, তার কয়েকটি সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কথায়ও উঠে এসেছে।

নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা করে কয়েক বছর আগে গঠিত হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দাবিতে লংমার্চ করে মতিঝিলে সমাবেশ করেছে, তাতে যোগ দিয়ে সংহতি জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা। সংহতি জানিয়েছে মহাজোট শরিক জাতীয় পার্টিও।

হেফাজতের ১৩টি দাবির চতুর্থটি হচ্ছে- ‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যাভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা’।

এছাড়া নারী উন্নয়ন নীতি বাতিলের দাবিও রয়েছে তাদের।

হেফাজতের বিশাল সমাবেশের মধ্যে কোনো নারীকে দেখা যায়নি। পেশাগত কাজে যে সব নারী সাংবাদিক গেছেন, তারাও জানিয়েছেন বিড়ম্বনার কথা।

শুক্রবার চট্টগ্রামে হেফাজতকর্মীদের বাধার মুখে পড়তে হয় সাংবাদিক সুমি খানকে, যার ধারাবাহিকতা ছিল ঢাকায়ও।

শুধু ‘নারী’ হওয়ার কারণে বিজয়নগরে হেফাজতকর্মীরা একুশে টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার নাদিয়া শারমীনের ওপর হামলা চালায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাদিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি সমাবেশে যাওয়ার সময়েই পল্টন মোড়ে কয়েকজন হেফাজতকর্মী এসে বলে- ‘মহিলা প্রবেশের অনুমতি নেই’।

“এরপর বলতে থাকে ‘আপনারা গণজাগরণ মঞ্চের দালাল’। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তারা হামলা শুরু করে। তখন পাশে থাকা একটি গাড়িতে আমি আশ্রয় নিলে তারা গাড়িও ভাঙার চেষ্টা চালায়।”

এক পর্যায়ে কয়েকজন সংবাদকর্মী নাদিয়াকে বিজয়নগরের দিকে নিয়ে যেতে চাইলে সেখানেই আক্রমণের শিকার হন তিনি।

“প্রায় ৫০/৬০ জন কর্মী আমার দিকে ইট ও পানির বোতল ছুড়তে থাকে। তারা আমার মোবাইল ফোন ও কয়েক হাজার টাকাসহ হাত ব্যাগটি নিয়ে যায়। এরপর আমাকে মাটিতে ফেলে মারধর করে।”

মাথা, ঘাড়ের বাম পাশে ও পায়ে আঘাত নিয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন নাদিয়া।

নাদিয়ার মতোই পল্টন এলাকায় কার্যালয়ে যাওয়ার সময় ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের স্টাফ রিপোর্টার আরাফাত আরা হেফাজত কর্মীদের বাধার মুখে পড়েন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেশ কয়েকজন হেফাজতকর্মী এসে আমার সিএনজি থামায়। এরপর আমাকে বলে, ‘আপনার মাথায় ওড়না নেই। আপনি এদিকে যেতে পারবেন না’।”

“আমি বললাম, মাথায় ওড়না নেই বলে যেতে পারব না কেন? আমি মাথায় ওড়না দেব কি দেব না, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আপনারা বলার কে? এরপরও তারা রাস্তা আটকে আমার সঙ্গে তর্ক করতে থাকে।”

তর্কাতর্কি করে বাধা উপেক্ষা করেই কার্যালয়ে যান আরাফাত আরা।

“কর্মস্থলে নারীদের এভাবে বাধা সৃষ্টি করাটা কল্পনাও করা যায় না। আমাদের দেশে নারীরা অনেক এগিয়েছে, এখন আবার পিছিয়ে নেয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে,” বলেন এই সাংবাদিক।

হেফাজতের সমাবেশের সময় ওই পথ দিয়ে চলাচলকারী বেশ কয়েকজন কর্মজীবী নারীকেও কটূক্তি শুনতে হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হেফাজতের সমাবেশের সময় রাস্তায় কাগজ ও পানির বোতল কুড়াতে গেলে ছিন্নমূল কয়েকজন নারীকেও বের করে দিতে দেখা গেছে।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পল্টন মোড়ে একজন বৃদ্ধা পানির বোতল কুড়াচ্ছিলেন। তাকে বলা হয়- ‘এটা মহিলাদের জায়গা নয়’।

হেফাজতকর্মীদের নারী বিদ্বেষী বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাসদ নেত্রী শিরিন আখতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবস্থা এমন মনে হচ্ছে যে, দেশটাকে তারা আফগানিস্তানের দিকে নিয়ে যেতে চায়।”

“তবে জনগণ এমনটি কখনো হতে দেবে না,” বলেন ৮০-এর দশকে জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী এই নারীনেত্রী।

সর্বশেষ আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার ৫১৮ জন, নারী ৭ কোটি ৬১ লাখ ১৭ হাজার ৪৯৭ জন।

ভোটার তালিকায় ৯ কোটি ২২ লাখেরও বেশি ভোটারের মধ্যে ৪ কোটি ৬৫ লাখ পুরুষ ও নারী ৪ কোটি ৬১ লাখ।

শিক্ষায় পুরুষের চেয়েও ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে নারী। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে ছাত্র ৭৮ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং ছাত্রী ৭৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। এছাড়া মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ছাত্র ও ছাত্রীর পাসের হার প্রায় সমান।

কর্মক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই নারী। দেশের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। সাংবাদিকতা, ক্রীড়া, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগেও নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে।

হেফাজতের দাবির প্রতিক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন, বিক্ষুব্ধ। এই বাংলাদেশ তো চাইনি আমরা।”

“এই যে নারীর প্রতি লাঞ্ছনা চলছে, এখন যদি কর্মক্ষেত্র থেকে নারীদের ফিরিয়ে নেয়া হয়, তাহলে কী অর্থনীতির চাকা ঘুরবে? আমাদের দেশের নারীরা তৃণমূল থেকে এখন হিমালয় শিখরে। ঠিক এই মুহূর্তেই নারীদের পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।”

গণশিক্ষা নিয়ে কাজ করা রাশেদা চৌধুরী বলেন, “নারীদের অধিকারের বিষয় এলেই বলা হচ্ছে, ধর্ম গেল। একজন নারী ধর্ষণের শিকার হলে তো এদেরকে (হেফাজত) আন্দোলন করতে পাওয়া যায় না।”

“শীর্ষ দুই দলের প্রধান নারী। আমরা তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দেখি তারা কী করেন। না হলে আমাদেরই পথে নামতে হবে,” বলেন তিনি।

(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন গোলাম মুজতবা ধ্রুব ও ফয়জুল সিদ্দিকী)