স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানো যে ৬৯ জন বিদেশি বন্ধুকে রোববার সম্মাননা দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে ১৩ জন ছিলেন পাকিস্তানি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যা শুরু করেছিল, বিবেকের তাড়নায় তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন এরা।
এজন্য নিজের দেশ ও সমাজে ‘বিশ্বাসঘাতক’ গালি শুনতে হয়েছে তাদের, সমাজে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছিল, কাউকে কাউকে যেতে হয়েছিল কারাগারেও।
দুঃসময়ের বন্ধু এই সব পাকিস্তানিদের হাতে সম্মাননা সনদ তুলে দেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই ১৩ জনের অনেকে আজ বেঁচে নেই। তাদের পক্ষে প্রতিনিধিরা সম্মাননা সনদ নিয়েছেন।
একাত্তরের শত্রু দেশের এই বন্ধুদের একজন বেগম নাসিম আখতার। তিনি পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
২৫ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরুর পরপরই প্রতিবাদ জানান এই রাজনীতিক। মার্চের শেষ সপ্তাহে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন লাহোরের মল রোডে।
নিজের দেশের বিপক্ষে গিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষ নেয়ায় শুধু নিজে নয়, নাসিমের পুরো পরিবার ও বাবার বাড়ির লোকজনকেও বিড়ম্বনা পোহাতে হয়।
বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হল, সেই ১৬ ডিসেম্বর নাসিম আখতার ছুটে গিয়েছিলেন লাহোর কারাগারে যেখানে বন্দি ছিলেন বাঙালি ছাত্র-যুবারা। সেখানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মিষ্টি বিতরণ করেন তিনি।
লাহোরে মল রোডে বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী বেগম তাহিরা মাজহার আলীও পাকিস্তানের সামরিক সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
বিভিন্ন ফোরামে বাঙালির ওপর নির্মম গণহত্যা ও অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেন এই মানবাধিকারকর্মী।
গণহত্যার বিবরণ শুনে কবিতা লিখেছিলেন আহমদ সালিম, যার জন্য কারাগারে যেতে হয়েছিল এই কবিকে। সামরিক আদালতে কারাদণ্ডের পাশাপাশি বেত্রাঘাতও সহ্য করতে হয় এই মানবাধিকারকর্মীকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির পক্ষে কলম ধরেছিলেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। বাংলাদেশে গণহত্যা ও নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-যাতনা নিয়ে কবিতা ও নিবন্ধ লেখেন পাকিস্তানের এই কবি ও সাংবাদিক।
২৫ মার্চের রাতের গণহত্যার ভয়াবহতা সচক্ষে দেখতে একদল ছাত্র নিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক ও সাংবাদিক ওয়ারিস মীর।
নির্মমতার চিত্র দেখে ক্ষুব্ধ এই সাংবাদিক তা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন দৈনিক জং পত্রিকায়।
তার ওই অবদানের স্বীকৃতি জানাতে বাংলাদেশ যে আয়োজন করেছে সেখানে ছুটে এসেছেন তার ছেলে হামিদ মীর, সংবাদপত্রে স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের দেয়া সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়ে তিনি ছুটে এসেছেন বাবার সম্মানের অনুষ্ঠানে।
বাংলাদেশে পরিচিত হামিদ মীর শনিবার ঢাকায় নেমে সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তানেও একদিন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে।
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করায় চাকরিচ্যুত হন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলট আনোয়ার পীরজাদো।
এজন্য সামরিক আদালতে তাকে সাত বছরের কারাদণ্ডও দেয়া হয়। তাকেও কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে বাংলাদেশ।
গণহত্যার কথা শুনে কারাগারে থেকেই ’২৬ মার্চ ১৯৭১’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন পীরজাদো, যাতে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আওয়াজ তোলা হয়।
হাবিব জালিব ছিলেন কবি ও রাজনীতিক। এই ন্যাপ নেতা পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য দেন। এর প্রতিবাদে কবিতাও লেখেন তিনি। এজন্য তাকে কারাগারে পাঠায় পাকিস্তানের সামরিক সরকার।
পাকিস্তানি দার্শনিক একবাল আহমেদ ১৯৭১ সালে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক প্রচারণা চালান তিনি। এজন্য তাকেও সম্মান জানানো হয়েছে।
একাত্তরে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মীর গাউস বকস বিজেঞ্জো। সে বছর মার্চে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। পরবর্তীতেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দলগতভাবে অবস্থান নেন তিনি।
মালিক গোলাম জিলানী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর তার মুক্তি দাবিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে খোলা চিঠি লেখেন তিনি। এজন্য কারাবরণ করতে হয় তাকে।
মালিক জিলানীর হয়ে সম্মাননা সনদ নেন তার মেয়ে আসমা জাহাঙ্গীর, মানবাধিকার আন্দোলনের এই নেত্রী বাংলাদেশেও পরিচিত মুখ।
সম্মাননা জানানো হয়েছে কাজী ফয়েজ মোহাম্মদকে, একাত্তরে যিনি ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুর সহযোগী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আত্মগোপনে থেকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার গণহত্যা বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে প্রচেষ্টা চালান তিনি।
স্বাধীনতার পর বিনা পাসপোর্টে গোপনে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে স্থায়ীভাবে এদেশে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে এবং তার মুক্তির দাবিতে পাকিস্তানের ৪৪ জন বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন সেটি তৈরি করেছিলেন শামিম আশরাফ মালিক। তার স্ত্রী নাসিম আখতারও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।
বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষ থেকে নেয়ায় পাকিস্তানে যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয় তাদের পক্ষে আইনি লড়াই চালান জাফর মালিক।
শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে দেয়া বিবৃতিতেও স্বাক্ষর ছাড়াও তার মুক্তির দাবিতে দল গড়ে তোলেন মালিক। এজন্য পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অনেক বিড়ম্বনা ও বঞ্চনার মুখোমুখি হন তিনি।
বিদেশি বন্ধুদের সম্মান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেছেন, “বাঙালি জাতির সেই ক্রান্তিকালে আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।”
“আমরা এজন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং চিরঋণী। আপনাদের এই অবদান, এই ঋণ পরিশোধ করার নয়।”