যে কারণে সাঈদীর ফাঁসি

ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেয়ার দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসি হয়েছে রাজাকার সাঈদীর।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2013, 05:00 PM
Updated : 28 Feb 2013, 08:57 PM

আরো ছয়টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবেই আদালতে প্রমাণিত হলেও অন্য অভিযোগে ফাঁসি হয়ে যাওয়ায় সেগুলোতে কোনো দণ্ড দেয়নি আদালত।

আট নম্বর অভিযোগে সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা ও পারেরহাটে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার অভিযোগ আনা হয়।

রায়ে বলা হয়, এই অভিযোগ প্রমাণে প্রসিকিউশন উপস্থাপিত ২, ৪, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ নম্বর সাক্ষীর উপস্থাপিত প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭১ সালের ৮ মে পাকিস্তান সেনারা বেশ বড় একটি রাজাকার দল নিয়ে মানিক পসারীর বাড়ি যায়, যে দলে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীও ছিলেন। ওই বাড়ি থেকে ইব্রাহিম ওরফে কুট্টি এবং মফিজ উদ্দিন পসারীকে ধরে নিয়ে আসে। এটা স্পষ্ট যে, সেইদিন পাক বাহিনী ও তাদের স্থানীয় রাজাকাররা বিভিন্ন বাড়ি থেকে মালামাল লুট করেছিল। পারেরহাট বন্দর সংলগ্ন ভাদুরিয়া ও চিতরিয়া গ্রামের রইস উদ্দিন পসারী, হেলাল উদ্দিন পসারী, সাইজুদ্দিন পসারী, মানিক পসারী, নুরুল ইসলাম খান ও অন্যদের বাড়িতে আগুন দিয়েছিলো।

নয়জন সাক্ষীর উপস্থাপিত প্রমাণাদি থেকে এটা বোঝা যায় যে, পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারদের দেখে ইব্রাহিম ওরপে কুট্টি এবং মফিজ উদ্দিন পসারী পালিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করেন। সে সময় রাজাকাররা তাদের ধরে এনে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে নিয়ে আসে পারেরহাট রাজাকার ক্যাম্পে। পথে একটি ব্রিজের নিকটে পাকিস্তানী সেনারা ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে এবং মফিজ উদ্দিনকে ক্যাম্পে এনে নির্যাতন করে। রাতে মফিজ উদ্দিন রাজাকারদের হাত থেকে পালাতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্রপক্ষের ৭ নম্বর সাক্ষী মফিজ উদ্দিন পসারী ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। রাজাকার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ভাগ্যক্রমে তিনি জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

“তিনি খুবই সুনির্দিষ্টভাবে সত্যায়ন করেছিলেন যে, অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী রাজাকার বাহিনীর একজন সদস্য হিসাবে তাদেরকে ধরে অপরাধস্থলে নিয়ে যান। চূড়ান্তভাবে ইব্রাহিম কুট্টি পাক সেনাদের হাতে নিহত হন। এই অবস্থায় ইব্রাহিম কুট্টিকে খুন, আগুন দিয়ে  বেসামরিক মানুষের ঘর-বাড়ি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ক্ষেত্রে আমরা প্রসিকিউশনের ৭ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যকে অবিশ্বাস করার মতো কোন কারণ খুঁজে পাইনি। এর মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে,” বলা হয়েছে রায়ে।

১০ নম্বর অভিযোগে বিসাবালীকে হত্যা ও উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় আগুন দেয়ার অভিযোগ আনা হয় সাঈদীর বিরুদ্ধে।

রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়, ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার হানা দিয়ে বিসাবালী হত্যা ও ২৫টি ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনা প্রমাণে প্রসিকিউশন ৩ জন সাক্ষীর উপস্থাপিত প্রমাণাদি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। অভিযুক্ত সাঈদী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এটা ঘটিয়েছিলো। প্রসিকিউশনের ১, ৫ ও ৯ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাঈদীসহ স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে উমেদপুর গ্রামের হিন্দু পাড়া আক্রমণ করে মূল্যবান মালামাল লুটপাট করে। সেখানে তারা অজ্ঞাতনামা বেসামরিক ব্যক্তিদের ২৫টি বসবাসের ঘরে আগুন দেয়।

“এটা স্পষ্ট যে, রাজাকাররা বিসাবালী নামে এক বেসামরিক ব্যক্তিকে ধরে নির্যাতন করে। এরপর তাকে নারিকেল গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়। পরে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর প্ররোচনায় তাকে সেখানে রাজাকাররা গুলি চালিয়ে হত্যা করে।”

প্রসিকিউশনের পাঁচ নম্বর সাক্ষী মাহতাবউদ্দিন হাওলাদার ও নয় নম্বর সাক্ষী আলতাফ হোসেন হাওলাদার চাক্ষুস সাক্ষী হিসাবে অভিযুক্তের প্ররোচনায় বিসাবালীকে হত্যা ও হিন্দুপাড়ায় আগুন দেয়ার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন।

“আগুন দেয়ার ধরন দেখেই বোঝা যায় যে, ঘটনার হোতারা বড় ধরণের ধ্বংসযজ্ঞ করতে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুপাড়ায় আগুন দিয়েছিলো। এটাও স্পষ্টভাবে গোচরে এসেছে যে, অভিযুক্ত ইচ্ছাকৃতভাবে বিসাবালী হত্যায় সহায়তা করেছিলেন, এটাকে সহজ করে দিয়েছিলেন। এই হত্যা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ তার উপস্থিতিতে এবং অংশগ্রহণে সংগঠিত হয়। এটা ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি হত্যা ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’

এই দুই অভিযোগ ছাড়াও ৬, ৭, ১১, ১৪, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।

রায়ে বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে ২০টি ঘটনায় সাঈদীর জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে, তার মধ্যে ১২টিই তারা প্রমাণ করতে পারেনি।

১, ২, ৩, ৪, ৫, ৯, ১২, ১৩, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২০ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি, যার মধ্যে পিরোজপুর সদর, মাসিমপুর বাসস্ট্যান্ড, পারেরহাট বাজার ও হোগলাবুনিয়ায় গণহত্যা এবং লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা, পিরোজপুরের পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনাও ছিল।