‘সঠিক সময়ে তারুণ্যের জোয়ার’

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে তৃতীয় দিনে গড়িয়েছে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে জনতার আন্দোলন।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবআশিক হোসেন, সুলাইমান নিলয়, ও সুজন মণ্ডলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2013, 10:50 PM
Updated : 7 Feb 2013, 04:13 AM

বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে প্রতিবাদী শ্লোগান-গণসংগীত আর যুদ্ধাপরাধীর কুশপুত্তলিকায় জুতা নিক্ষেপের মাধ্যমে মুখরিত হয়ে ওঠেছে এ সমাবেশস্থল।   

মঙ্গলবার বিকাল থেকে শুরু হওয়া এ জমায়েত বুধবারও রাত কাটিয়েছে শাহবাগ মোড়েই। বৃহস্পতিবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন নানা শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষ।

সকাল ৭টার দিকে প্রতিবাদী গান শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তীরন্দাজ’। ৮টার দিকে ঘোষণামঞ্চ থেকে আহ্বান জানানো হয় চারদিকে গোল হয়ে অবস্থান নেয়ার জন্য। ১৫ মিনিটের মধ্যে মোড় ঘিরে চারদিকে গোল হয়ে অবস্থান নেয় সমবেতরা।

এ সময় শ্লোগানে শ্লোগানে ভরে ওঠে পুরো এলাকা- শহীদের রক্ত /আপোসরফা করে না, এসো ভাই এসো বোন/গড়ে তুলি আন্দোলন, জ্বালো জ্বালো/আগুন জ্বালো, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই/কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়/কাদের মোল্লার ঠাঁই নাই, কাদের মোল্লার কবর হবে/পাকিস্তানের মাটিতে, রাজপথের সংগ্রামে/কথা হবে শ্লোগানে।

এক পর্যায়ে ঘোষণামঞ্চ থেকে বলা হয়, “আমরা আবারো নতুন দিনে নতুন উদ্যোমে আমাদের দাবি আদায়ের কর্মসূচি শুরু করলাম। যতোদিন কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় না আসবে, ততোদিন আমরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাব।”

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কোনোভাবে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠা শাহবাগ ছেড়ে না যাওয়ার প্রত্যয় ঝরে ফুটে ওঠে সকলের কণ্ঠে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদী মঞ্চ ঘিরে বাড়ছে সংহতি জানাতে আসা মানুষের সংখ্যাও।

বিশেষ করে স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে আসতে থাকেন শাহবাগের দিকে। প্রায় সবার মাথা আর হাতে বাঁধা লাল-সবুজ পতাকা। আর মুখে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শ্লোগান, কখনো বা দেশগান, গণসংগীত।

সকাল ১০টার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ঢাক-ঢোলসহ মিছিল নিয়ে সংহতি জানাতে আসেন তরুণ-তরুণীরা।

ঘোষণা মঞ্চ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের খবর উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। এই বার্তা যেন তাদের রাত জাগার ক্লান্তি অনেকটাই ভুলিয়ে দেয়।

সকাল সাড়ে ১০টায় ঘোষণা মঞ্চ থেকে জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছেন।

মঞ্চ থেকে ক্রমাগতভাবে স্লোগান চলেতে থাকে, ‘ক তে কাদের মোল্লা/তুই রাজাকার তুই রাজাকার’; ‘ন তে নিজামী/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার; ‘ম তে মুজাহিদ/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার’; ‘গ তে গোলাম আযম/ তুই রাজাকার তুই রাজাকার’।

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভ মঞ্চে রাজাকারদের কুশপুত্তলিকায় জুতা নিক্ষেপ চলে।

আগের দুদিনের মতো বৃহস্পতিবারও অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহবাগ মোড়ে আসেন তরুণদের এ আয়োজনে সংহতি জানাতে। এদেরই একজন ধানমন্ডি শংকরের বাসিন্দা আমিরুদ্দিন আহমেদ।

আবেগভরা কণ্ঠে ষাটোর্ধ এ মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “আমি প্রাণ ভরে দোয়া করি, ওরা অনেক বড় হবে। জাতির মেরুদণ্ড আজ শক্ত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এ প্রজন্ম অনেক একতাবদ্ধ। বায়ন্ন থেকে একাত্তর এবং পরবর্তীতে যে বাঁধন ছিঁড়ে গিয়েছিল, আজ এখানে এসে মনে হচ্ছে সে বাঁধন আসলে ছেঁড়েনি। আমাদের সন্তানদের হাতেই আমাদের পতাকা নিরাপদ।”

এ সময় আমিরুদ্দিনের পাশে ছিলেন তার স্ত্রী রিজিয়া আমির।

রিজিয়া বলেন, “ওরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ জাতিকে আর দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়।”

ইস্কাটন রোড এলাকার বাসিন্দা হাফিজ আল আসাদ সারারাত ছিলেন শাহবাগে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। রাতে জাদুঘরের সামনে সবজি খিচুরি রান্না হয়েছিল। সবাই ভাগাভাগি করে খেয়েছি, একেক প্লেটে দুইজন।”

এছাড়া সমাবেশস্থলে সারারাত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদসহ কয়েকটি সংগঠন।

এদিকে শাহবাগ চত্বর প্রতিবাদকারীদের দখলে থাকায় কাঁটাবন, মৎস্যভবন ও রূপসী বাংলা মোড় থেকে শাহবাগ পর্যন্ত সড়কে ব্যারিকেড বসিয়েছে পুলিশ। ফলে যানবাহন চলছে বিকল্প পথে। কিছু সড়কে যানজটও সৃষ্টি হয়েছে।

মঙ্গলবার যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে সেদিন রাত থেকেই শাহবাগে বিক্ষোভ শুরু হয়। দাবি আদায়ে শুক্রবার মহাসমাবেশেরও ডাক দেয়া হয়েছে।

শাহবাগে আন্দোলন শুরুর পর তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য স্থানে। কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ-সমাবেশ চলছে।